আজ আমাদের ডির্ভোস হবে। দীর্ঘ চার বছরের প্রেম আর তিন বছরের বৈবাহিক জীবনের ইতি টানবো আমি। আমার বউ মুন দুই মাস আগেই তার বাবার বাড়ি চলে গেছে।
গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে অকারণেই মুনের সাথে খারাপ ব্যাবহার করতাম আমি। ব্যাস্ততা দেখিয়ে দেরিতে বাসায় ফিরতাম। ঠিক ভাবে কথা বলতাম না। হুট করে একদিন সকালে। খুব ছোট একটা ব্যাপার নিয়েই মুন কে একটা থাপ্পড় দেই। সেই দিনই প্রথম আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো, তার সাথে কেনো আমি এত খারাপ ব্যাবহার করছি ?
উত্তরে শুধু বলেছিলাম, "তোমাকে আর আমার ভালো লাগে না " ।
আমার এই উত্তরে মুন কি বুঝলো কে জানে। খুব মিষ্টি করে মুখে একটা হাসি টেনে মুন শুধু বল্ল, পৃথিবীতে সব রোগের ঔষুধ আছে। শুধু "ভালো লাগে না "এই রোগটার কোনো ঔষুধ নেই, থাকলে তোমায় একটা খাইয়ে দিতাম আমি। তখন আমাকে তোমার আবার ভালো লাগতো।
ওই দিন বিকালেই মুন তার বাবার বাড়ি চলে যায়। কিছু দিন আগে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। আমাদের ডির্ভোস এর ব্যাপারটা। মুনের কথা অনুযায়ী যেহেতু আমার এখন আর মুন কে ভালো লাগে না। সুতরাং এই সম্পর্ক টা থেকে দুজনকেই এখন বের হওয়া উচিত।
মুন কে আমি বলি নি। প্রেমিকা মুন আর স্ত্রী মুনের মধ্যে অনেক পার্থক্য। বিয়ের আগে মুনের হাতে সব সময় মেহেদী রাঙা থাকতো। বিয়ের পরে সেই হাতে জায়গা করে নিয়েছে হলুদ আর মরিচের দাগ। যখন প্রেম করতাম তখন মুনের পাশে বসলেই পেতাম পারফিউমের ঘ্রাণ। কিন্তুু বিয়ের পর রোজ সকালে আমি যখন ডাইনিং টেবিলে খেতে বসি।মুন যখন আমায় খাবার বেড়ে দিতে কাছে আসে। তখন আমি ওর শরীর থেকে পেঁয়াজ, রসুন আর ঘামের গন্ধ পাই। আগে মুনের শ্যাম্পু করা চুল দেখে যে প্রশান্তি টা পেতাম। এখন মুনের তেল দেওয়া চুল দেখে সেই প্রশান্তি টুকু পাই না।সব মিলিয়ে আমার প্রেমিকা মুন কেই ভালো লাগতো। বউ মুন কে ভালো লাগে না।
কোর্টে ঢুকার সময় এক বয়স্ক দম্পতির সাথে দেখা হলো আমার। আমি কোনো কিছু না ভেবেই তাদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম। তারা এখানে কেনো এসেছে, বৃদ্ধ মহিলাটি বল্ল,জমি নিয়ে কি এক সমস্যা তাই তারা এখানে এসেছে। কথার এক ফাঁকে হুইল চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটিকে দেখিয়ে বল্ল, বুঝলে বাবা ! অসুস্থ মানুষটিকে নিয়ে এসেছি কোর্টে। কত সময় কি লাগবে আল্লাই ভালো জানেন।
আমি খেয়াল করলাম, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া একজন হুইল চেয়ারে বন্দী মানুষটার প্রতি মহিলাটির কত কেয়ার । সংসার জীবনে যখন প্রথম পা দিয়েছিলো। তখন হয়তো দুজনই খুব চঞ্চল ছিলো। আজ সময়ের ব্যাবধানে একজন হুইলচেয়ারে বন্দী।
আমি তখন অনুভব করলাম।প্রেমের জন্য দামি পারফিউম, শ্যাম্পু করা চুল আর কুড়ি বছরের টান টান উজ্জ্বল চামড়া হলেই যথেষ্ট। কিন্তুু সারা জীবন পাশে থাকার জন্য প্রয়োজন কেয়ার আর ভরসা করার মত একটা হাত। যে হাত যেকোনো খারাপ -ভালো সকল পরিস্থিতি তেই ভরসা দেবে।
দশটায় উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও। আমি উপস্থিত হলাম দশটা উনিশ মিনিটে। কোর্ট এর ভেতরে উকিলের সামনে বসে আছে মুন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বসা। আমি রুমের মাঝে ঢুকতেই। একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টা নিচের দিকে নামিয়ে নিলো । চেয়ারে বসতেই শুনতে পেলাম, মুন খুব স্বাভাবিক গলায় উকিল কে বলছে ডির্ভোস পেপারটা দেওয়ার জন্য।
হুট করে এক প্রকার চিল্লিয়েই আমি বল্লাম, ডির্ভোস পেপারে সাইন টা আমি আগে করতে চাই ?
মুন কোনো কথা না বলেই, কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
কাগজ টা হাতে নেওয়ার পর একটা কথাই আমার মাথায় আসলো। মুন আমার জীবনে সেই ভরসার হাত। যে হাত সব সময় আমাকে আগলে রাখবে। চট করে সাইন করার জায়গায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখলাম। " তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না "।
এরপর কাগজ টা মুনের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে কাগজটায় দু মিনিট চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো। সে সাইন করা জায়গায় খুব চমৎকার করে লিখলো "যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে। তবু মনে রেখো আমারে "
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা আমাদের ডির্ভোস পেপারটাকে প্রেম পত্র বানিয়ে ফেল্লাম।