এক সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু প্রশ্ন করেছিলেন, 'এ দেশে গান করে কী হবে'?
দেশের একজন কিংবদন্তি ও সফল সংগীতশিল্পী যখন এমন প্রশ্ন করেন, সত্যি অসহায় লাগে। অসহায় লাগে লেখক হিসেবে। আমরা লেখকরা কি এই প্রশ্ন করতে পারি, এই দেশে লেখালেখি করে কী হবে?
একটা জাতির মনন তৈরি করেন লেখকেরা। সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, সংবাদমাধ্যম এর মূল কারিগর হচ্ছেন লেখক।
কিন্তু লেখক হয়ে আমার উপলব্ধি, এই দেশে লেখালেখি করে আর যাই হোক, জীবনধারণ করা সম্ভব নয়।
একটি টিভি নাটকে যতজন সম্পৃক্ত থাকেন, সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক পান নাট্যকার। একটি গানে সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক পান একজন গীতিকার। একটি চলচ্চিত্রে সবচেয়ে কম পারিশ্রমিক পান চিত্রনাট্যকার। সাংবাদিকদের বেতন হয় না।
স্বাভাবিকভাবে সেই নাট্যকার বা লেখক তামিল-হিন্দি ছবির কাহিনি কপি-পেস্ট করবে। কিংবা এইভাবে বলি: সিস্টেমটাই এমন হয়ে গেছে, কপি পেস্ট করার চেয়ে বেশি মেধাবীরা সেখানে যাবে কেন? কেন আপনারা প্রত্যাশা করেন আমাদের গান-নাটক-সিনেমা ভালো হবে?
লেখকদের পেছনে আমাদের সমাজের বিনিয়োগ কতটা?
***
আমাদের দেশে লেখককে একই সঙ্গে আরও একটি পেশা বেছে নিতে হয়। কিংবা মূল একটি পেশা দিয়ে জীবন ধারণ করার পাশাপাশি লেখক হতে হয়। অথচ লেখালেখি কখনো পার্ট টাইম কাজ হতে পারে না।
আমি তো চাই সারা দিন আমি ঘরের এক কোণে বসে লিখব আর লিখব। তাতে আমার সংসার কি চলবে? ফলে আমাকে চাকরি করতে হয়। সারা দিনে সব জীবনীশক্তি অফিসে খরচ করে এসে কখনো কখনো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাসায় বসে লিখতে হয়। যে লেখাটা আমার লেখা উচিত ছিল মানসিকভাবে সবচেয়ে তরতাজা অবস্থায়, সেটিই আমি লিখি যখন আমি শব্দ খরচের দিক দিয়ে ক্লান্ত, নিঃশেষিত।
আজ চারদিকে একটা মেধাশূন্যতার হাহাকার শুনি। আপনারাই বলেন, ভালো নাটক হচ্ছে না। ভালো গান হচ্ছে না। কেন অর্ণব আজ গান করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন?
অবশ্য আপনারা ভাবতে পারেন, ছি ছি। আপনারা লেখক-শিল্পীরা টাকার লোভ কেন করেন? লেখক শিল্পীরা তো হাওয়া-বাতাস খেয়ে বাঁচে। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি জীবনানন্দ দাশ ট্রামের তলায় মরবেন। আর বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম গদ্যকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিদারুণ অর্থকষ্টে রোগেশোকে ভুগে মারা যাবেন। এটাই হচ্ছে আমাদের ঠিক করে দেওয়া স্ট্যান্ডার্ড!
শরৎচন্দ্র বা হুমায়ূন আহমেদকে উদাহরণ হিসেবে দেখাবেন না, প্লিজ। আমি সামগ্রিক ছবিটা বলছি, ব্যতিক্রম নয়। আর হুমায়ূনকেও কেন ৩০০টার মতো বই লিখে যেতে হলো, সেটার উত্তরও কেউ কি দেবেন?
***
আমরা এখন যে সমাজ তৈরি করেছি, তাতে একজন লেখক ফেসবুকে গোটাকয় লাইক, আর 'বাহ লেখাটা বেশ ভালো হয়েছে' ছাড়া আর কী পায়?
নানা পত্রপত্রিকায় এখন পর্যন্ত আমার ১৮টি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। আমি পাঁচটি গল্পের জন্য পারিশ্রমিক পেয়েছি। এর মধ্যে দুটি গল্পের পারিশ্রমিক ছিল ২৫০ টাকা। বাকি সব লেখার
ক্ষেত্রে আমাকে ভলান্টারি সার্ভিস দিতে হয়েছে। কারণ লেখালেখি বাংলাদেশে একটি স্বেচ্ছাসেবী কাজ। লেখা ছাপা হওয়াটাই এখানে যথেষ্ট বলে ধরে নেন পত্রিকার মালিকপক্ষ।
***
অথচ বাংলা ভাষা পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। অথচ বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ।আমাদের শিক্ষিতের হারও কম নয়। সমস্যা তাহলে কোথায়?
আমরা সিগারেট পুড়িয়ে, চা খেয়ে, বাদামের খোসা ছিলে দিনে ২০০ টাকা খরচ করে ফেলতে রাজি। ৩০০ টাকার লিপস্টিক কিনে ফেলি, অথবা ফুটপাত থেকে ১৫০ টাকায় কিনি একটা টি-শার্ট। কিন্তু এখনো ১৫০ টাকা দামের বইয়ে ব্যাপারে ভাবি, এ-ত টাকা! মেলায় কারও ২০০ কপি বই বিক্রি হলে তাকে ধরে নেওয়া হয় সফল লেখক!
***
পত্রিকার যে পাতায় আইয়ুব বাচ্চুর ওই সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে, তার আগের পাতায় ছাপা হয়েছে আরেকটি খবর। বাংলাদেশে ২ কোটি মানুষ নিয়মিত ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে। কিন্তু সে তুলনায় বাংলা কনটেন্ট নেই। মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে ভালো কিছু পড়বে, তার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
যে শূন্যতা পূরণ হচ্ছে নিন্মমানের, বাজে, ভুয়া কনটেন্ট দিয়ে। আর এসব পড়ে পড়ে যে সমাজ তৈরি হচ্ছে, তার ফলাফল বোঝা যাবে শিগগিরই। লেখকরা সমাজের মনন যদি তৈরি করতে পারেন, 'লেখক'দের কারণে তা ধ্বংসও হতে পারে বইকি।