তুমি জানো? পৃথিবীতে সবচাইতে ভয়ংকর রকমের শাস্তিটা হলো একজন কে বিয়ের আগে ভালোবাসা ।
বিয়ের আগে তো তেমন অধিকারবোধটা থাকেনা তাই সবসময় তাকে হারিয়ে ফেলবার একটা ভয় মস্তিষ্কে তীব্রভাবে আঘাত করতে থাকে । একজন মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে মানসিক ভাবে ভেঙে দেয়া সম্ভব ।
তুমি যখন আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালে সেই সময়টা আমার জন্য ছিলো এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মত । তোমার মৃত্যুর খবর শোনামাত্রই ছুটে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। ব্যান্ডেজ পরা নিথর শরীরটা ছুঁতে মন চাইছিল একটাবার কিন্তু খালাম্মা দিলেন না , কুকুর বেড়ালের মত দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন আমায় । তুমি তো জানো আমার জিদ কত? আমি অত অপমান সহ্য করেও পিছু পিছু গিয়েছিলাম তোমার বাড়ি অবধি । উঠানের এক কোণে জলচৌকি পেতে শোয়ানো হয়েছিল তোমায় । আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে কল্পনা করছিলাম এখনই উঠে তুমি চমকে দিবা সবাইকে। কিন্তু কল্পনা তো কল্পনাই , সত্যি তো আর নয়!
গোসল দেবার পূর্ব মুহুর্তে রাশেদ ভাইয়ের পায়ে পড়ে রিকোয়েস্ট করছিলাম একটাবার তোমার গলা জড়িয়ে ধরবো কিন্তু উনিও আমার কথা শুনলেন না । গোসল হলো জানাজা হলো , কবরে নামানোর সময় আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি ।
সকলের বাঁধা উপেক্ষা করে তোমার গলা জড়িয়ে ধরেছি । আমার ফিসফিসিয়ে বলা কথা গুলো কি শুনতে পেয়েছিলে? আচ্ছা মৃত মানুষরা কি কথা শুনতে কিংবা বুঝতে পারে?
তোমার গলা জড়িয়ে ধরার অপরাধে আমায় কিন্তু সেদিন বেদম মার খেতে হয়েছিল । রাশেদ ভাই আমার তল পেটে লাত্থি দিয়েছিলেন দু'টো । সব মার নীরবে হজম করতে পারলেও লাত্থি টা পারিনি । যন্ত্রনায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম । চেতনা যখন ফেরে তখন ভোর রাত্তির , আজানের ধ্বনিতে মুখরিত চারিদিক । কষ্ট করে কিঞ্চিৎ চোখ মেলতেই নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করলাম ।
পাশেই একজন নার্স আমার ঔষধ পত্র গুছিয়ে রাখছে । পেটের উপর হাতটা নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে তাকে প্রশ্ন করলাম_
-- আমার বাচ্চাটা?
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল_
-- বেঁচে আছে কিন্তু তুমি যেভাবে আঘাত পেয়েছো! তোমার বাচ্চা সুস্থ সবল ভাবে জন্মাবে কি না সন্দেহ ।
আমি এটা শুনেও কাঁদলাম না । কেবল মনে মনে আওড়ে গেলাম_
প্রচন্ড গতিতে ছুটে আসা এক যান্ত্রিক ধাতব শরীরের আলতো স্পর্শ। থ্যাচ শব্দে কিছু আশা,ইচ্ছা,ভরসা,স্বপ্ন যোগফলে একটা গল্পের সমাপ্তি...(রোহান)
বাকি সাড়ে আট মাস কেটে গেলো সহজেই । আমার সকল কষ্ট , চাপা আর্তনাদের সংক্ষেপিত রূপ সহজেই ।
সাড়ে আট মাস কিন্তু আমি এক ফোঁটা অশ্রুও ঝরাই নি তবে প্রতিনিয়ত তোমার শূন্যতা মনে করিয়ে দিয়েছি একটা নারীর জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া কতটা ভয়ানক ।
মাঝেমধ্যে ব্যালকনিতে বসে নিস্তব্ধ শহরটা অবলোকন করতে করতে ভাবতাম , এত একা কেনো আমি? এই একাকিত্ব যে ভয়ংকর- নিষ্ঠুর , শ্বাসরুদ্ধকর বান্ধবহীনতা । উফফ কি দিন পার করেছি জীবনের!
অভি যেদিন হলো , ওকে কোলে নিয়ে সেদিন জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম । তোমাকে হারানোর শোক , জীবনের সব ব্যর্থতা এটসেটরা এটসেটরা.. সব কান্না একসাথে কেঁদেছিলাম । আমার আহাজারীতে বোধকরি আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল ।
ঐ ছিলো একটা দূর্বল মেয়ের জীবনের শেষ কান্না।
অভির ছোট্ট আঙুল চেপে ধরে নতুন জগতে পা দিলাম আমি। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ ছিলো , পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আর ।
আজ আমার কাছে সব আছে নাম-যশ-অর্থ কেবল তুমি নেই । তুমি হীন পৃথিবীটা বড্ড বিষাক্ত , প্রতিনিয়ত একেকটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সামনের দিকে পা বাড়াই । কে জানে মন থেকেই সবটা আসে নাকি কেবলই অভিনয় । অভিনয় যদি করেই থাকি তবে বলতে হয় অভিনেত্রী হিসেবে খারাপ নই আমি , বলো?
যাক গে অনেক কথাই তো বললাম । আর কয়েকটা শেষ কথা বলে নিই?
অনিমেষ আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি গো। কথা দিয়েছিলাম না শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মুহুর্ত পর্যন্ত ভালোবেসে যাবো? দেখো আমি আমার কথা রেখেছি । এবার কি আমি একজন ভালো প্রেমিকা নামে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা রাখি?