বাবা সবসময় বলতেন, 'তোর জন্য ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্তুর আসবে'।
মেয়েটা বলত, 'কেন বাবা?'
বাবা বলতেন, 'কারণ তুই যে রাজকন্যা'।
মেয়েটা বলত, 'আমার বাবা কি তবে রাজা?'
বাবা হাসতেন, তারপর বলতেন, 'হু, এমন রাজকন্যা থাকলে তার বাবা রাজা না হলে কি হয়?'
মেয়েটা বলত, 'তুমি তাহলে সত্যি সত্যি রাজা?'
বাবা হাসতেন। তারপর ছোট্ট পরি মেয়ের গালে গাল চেপে ধরে বলতেন, 'উম্মম্ম...'
বাবা জ্বরে ডুবে আছেন।
ছোট্ট পরির মুখ ভার। সে দরজার আড়াল থেকে দেখে। সারা রাত জেগে মা এখন নিঃসাড়ে ঘুমোয়। রাতজুড়ে কত কী! কপালে জলপট্টি অবধি। আচ্ছা, জলপট্টি দিলে কী হয়?
জ্বর ভালো হয়ে যায়?
ছোট্ট পরী মেয়ে বাবার গা ঘেঁসে দাঁড়ায়, এই বাবাটা কেমন ধূসর, শুকনো মুখের মানুষ। বাবার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? খুব? পরি মেয়ে তার বেণী করা চুলের ফিতে খুলে ফেলে, তারপর বেসিনের জলে ডুবিয়ে নিয়ে বাবার কপালে বেঁধে দেয়। বাবা চোখ মেলে তাকান, ঠিক সামনের আয়নায় তার চোখ, টুকটুকে লাল ফিতে তার কপাল জুড়ে। পরি মেয়েটা বড়দের মত করে বলে, 'রাজামশায়ের জ্বর কি তাহলে কমল?'
বাবা হাসেন, দুহাতে জাপটে ধরেন তার রাজকন্যাকে, বুকের ভেতর। এমন রাজকন্যা থাকলে রাজা মহারাজাদের জ্বর না কমে যাবে কোথায়!
বাবা রাজকন্যাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটেন, কোলের ভেতর বেড়ালের ওমে ঘুম পাড়ান, সারা বাড়ি ঘুরে ছোটেন, তারপর অফিস, মিটিং, রোদ, ঘাম , জলের দিনরাত্রি, বাজারের সওদা, দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতি... দিন শেষে হতাশায় ক্লান্তিতে গম্ভীর মুখে ঘরে ফেরাও থাকে। কিন্তু পরি মেয়ে এসে বলে, ' তুমি কি আমার ফকির বাবা?'
বাবা গম্ভীর মুখে বলেন, 'কেন মা?'
- আজকাল আমায় যে আর রাজকন্যা বলে ডাক না?'
ক্লান্তিরা ডানা ঝাপটে পালায়, দুশ্চিন্তাও। বাবা আবার রাজা মহারাজা হয়ে যান মুহূর্তেই, তার বুকের ভেতর ডানা ঝাঁপটায় রাজকন্যা।
বাবারা জানেন, তার ঘরের চৌকাঠ পেরুলেই এই জগতজুড়ে তার রাজকন্যাদের জন্য আর সত্যিকারের রাজপুত্তুররা অপেক্ষায় থাকে না। বরং নখর বাগিয়ে ওঁত পেতে থাকে পুরুষের বেশে ভয়ংকর সব শ্বাপদ। হয়তো তাই, পৃথিবীর সকল বাবাই তার বুকের ভেতর আজীবন তার রাজকন্যাদের পুষে রাখতে চান...
হয়তো তাই, জগতজুড়েই সকল মেয়ের বুকের ভেতর ফিসফিসিয়ে বাজে,
"আমি প্রিন্সেস না কারণ আমার প্রিন্স রয়েছে তবে আমার পিতা একমাত্র রাজা!"