'তোমার নাম কি মা?'
'মিষ্টি।'
'তুমি দেখতেও খুব মিষ্টি।'
'আমি খেতেও খুব পছন্দ করি মিষ্টি। কিছু মনে না করলে একটা খাই?'
মেয়ের এমন কথায় ছেলে পক্ষ খানিকটা বিব্রতবোধ করলেও একজন হেসে বললেন, 'অবশ্যই।'
মিষ্টির বাবা মা চোখে ইশারা দিয়ে নিষেধ করা সত্ত্বেও মিষ্টি টেবিলের উপর মেহমানদের জন্য রাখা মিষ্টিগুলো থেকে একটা মিষ্টি তুলে মুখে পুরে দিল৷
'মিষ্টিগুলো খুব সুন্দর। আপনারাও নিন।'
মেয়ের এমন আচারণে লজ্জায় মাথাকাটা যাচ্ছে মেয়ের পরিবারের। মেয়ে দেখার আসরে মেয়ে লজ্জায় চুপ করে রইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে ঘটছে উল্টো। মিষ্টির এমন কর্মকাণ্ডে ছেলে পক্ষ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
মিষ্টি বললো, 'তারপর আপনাদের ছেলেকে সঙ্গে করে আনেন নি কেন? ছেলেটার মুখখানা দেখারও তো দরকার আমাদের৷'
ছেলে পক্ষের একজন আমতা আমতা করে বললেন, 'ও আসলে একটু কাজে আঁটকে পড়েছে। তাই আসতে পারে নি।'
'মেয়ে দেখাও তো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।'
চুপ করে রইলেন সকলে। মিষ্টির আচারণে ছেলের পরিবারের সকলেই বেশ অবাক।
নীরবতা কাটিয়ে মিষ্টি বললো, 'আপনাদের ছেলেকে জানিয়ে দিবেন তাকে আমাদের পছন্দ হয় নি।'
এবার সবার চোখ কপালে উঠলো। ছেলে না দেখেই ছেলে অপছন্দ করার বিষয়টা ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। মিষ্টির বাবা-মা মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মিষ্টি শান্ত স্বরে বললো, 'ভুল বলি নি৷ ঠিক'ই বলেছি। আপনার ছেলের বিষয়ে আমি খোঁজ নিয়েছি৷ ভালো কিছু শুনতে পাই নি৷ অনেক মেয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল তার। প্রতারণা করে ঠকিয়েছে সবাইকে।'
ছেলের মা কড়া স্বরে বললেন, 'বিয়ের আগে ছেলেদের এমন একটু আধটু সম্পর্ক থাকতেই পারে। বিয়ে তো ছিল না।'
'মায়ের যেমন চিন্তা, ছেলের তেমন কর্ম। বিয়ের আগে অবৈধ সম্পর্ক গড়লে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো বিয়ে করে বৈধতা দিলে!'
এবার আর উত্তর নেই কারো কাছে।
'আপনারা যেতে পারেন।'
বেশ অপমানবোধ নিয়েই ছেলে পক্ষ বিদেয় হলে মিষ্টির বাবা হতাশ কণ্ঠে বললেন, 'আর কত বিয়ে ভেঙ্গে দিবি এভাবে? কত দোষ খুঁজে বের করবি?'
'যতদিন ভালো একটা মানুষ না আসে। বাবা একটা কথা ভাবো, আজ যদি তোমার মেয়ের এতটুকু দোষ থাকতো। তবে বিশ্বাস করো, কেউ ছোট করে ভাবতো না। আত্মীয় স্বজন, পাড়া-পড়শী কেউ না। বরং সবাই আরও বিষয়টা বড় থেকে ক্রমশ বড় করে তুলতো।'
মিষ্টির এই প্রতিবাদী আচারণের জন্যই সবার কাছে বেয়াদব মেয়ে হিসেবে পরিচিত সে। মুখের উপর তিক্ত সত্য কথাটা বলতে একটু বাধে না তার মুখে। এই কারণে অনেকে এড়িয়েও চলে তাকে।
বিকেলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি। প্রতিদিনের মত একটা ছেলে আজও রাস্তার ওপাশে দাড়িয়ে মিষ্টির কক্ষের দিকে তাকিয়ে আছে ফ্যাল ফ্যাল করে।
মিষ্টির পাশে এসে দাড়ায় ছোট বোন ঐশি।
'আপা, রোজ এই ছেলেটা তোর জন্য বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এক কাজ কর, তুই তাহলে এই ছেলেটাকে বিয়ে করে নে।'
'ও আমার একার বাসার সামনে দাঁড়ায় না। আমার বাসার সামনে আসার আগে আরও দুইজনের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে৷ এখান থেকে গিয়েও একজনের বাসার সামনে দাঁড়াবে।'
বেশ অবাক হয়ে বলে উঠলো ঐশি, 'কি বলিস!'
'হ্যাঁ, মানুষের উপর দেখে ভেতর বুঝা যাবে না স্বাভাবিক।'
'আপা, পরশু নাকি আবার তোকে দেখতে আসবে। এই ছেলের বিষয়ে তোর মত কি?'
'বিয়ে হচ্ছে না। নিশ্চিত থাক।'
'বাবা তো বললো এই ছেলে খুব ভালো। তাহলে?'
'দেখাদেখির আসরেই বলবো। তখন শুনিস।'
এবারের ছেলের বিষয়ে বেশ খোঁজ খবর নিয়েছেন মিষ্টির বাবা। কোনো ত্রুটি তার কানে আসে নি। সেই প্রেক্ষিতে তিনি এবার আশাবাদী বিয়ের বিষয়ে।
মাথায় কাপড় টেনে বেশ ভদ্রভাবে বসে আছে মিষ্টি৷ ছেলে পক্ষ থেকে পাঁচ জন এসেছে। কিন্তু ছেলে আসে নি।
ছেলের মা আর বাবা একের পর এক প্রশ্ন করেই চলছে।
'তুমি রান্না জানো মা?'
'জ্বী।'
'কোরআন পড়তে জানো?'
'জ্বী'
'নামায পড় তো?'
'জ্বী।'
'তুমি বোরখা পরো তো?'
'জ্বী।'
বেশ খুশি মুখে ছেলের বাবা বললেন, 'আলহামদুলিল্লাহ্। মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আর আমাদের ছেলেও খুব ভদ্র। আমাদের পছন্দ'ই তার পছন্দ।'
মিষ্টি হেসে বললো, 'তা আপনাদের ছেলে কি কি জানে?'
এমন প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে গেল সবাই।
'রাস্তায়, কলেজে, গাড়িতে, পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে এমনকি ফেসবুকেও মেয়েদের উত্যক্ত করা ছাড়া আর কি কি জানে আপনাদের ছেলে?'
শান্ত পরিবেশটা মুহুর্তেই অশান্ত হয়ে উঠলো।
'আজকালকার ছেলেরা এমন বাউন্ডুলে থাকে। চাকুরি পেলে আর বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যায়।' ছেলের বড় বোনের উক্তি।
'আপনার ভাই চাকুরি পাওয়ার পরেও পুরাতন পেশা বদলায়নি। আগে সবসময় করতো আর এখন সুযোগ পেলে করে। মেয়েদের বিরক্ত করা ছেলের জন্য খুঁজতে এসেছেন ভালো পরিবারের ভদ্র, নম্র, পর্দানশীন এবং সুন্দরী মেয়ে! একটা খারাপ মানুষের সঙ্গে একটা ভালো মানুষের কি করে যায় বলুন তো? আগে ঘরের ছেলেকে ভালো মানুষ হিশেবে তৈরি করুন, তারপর ভালো মেয়ে খুঁজতে বের হবেন।'
নিরাশ হলেন মিষ্টির বাবা। এবারের বিয়েটাও হচ্ছে না সে নিশ্চিত। বরাবরের মত ছেলে পক্ষ মাথা নিচু করে বিদায় হলো।
বাহিরে অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। চুপচাপ নিজের কক্ষে বসে আছে মিষ্টি। হঠাৎ তার মা এসে জানায় তার খালাতো বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে আজ সন্ধ্যায়।
তিনি ক্ষোভ নিয়ে বললেন, 'দেখলি মিষ্টি, ওরা মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দিল আর একটাবার আমাদের জানালো না।'
মিষ্টি কিছু বলার আগেই তার মা বললেন, 'অবশ্য না জানিয়ে ভালো করেছে৷ আমরা গেলে এই বিয়েটাও হতো না। তুই কোনো না কোনো দোষ বের করে এটাও ভেঙ্গে দিতি আগেরটার মতই।'
'মা আমি আগের বিয়েটা ভাঙ্গিনি।'
'মামার বাড়ির গল্প মা'কে আর শুনাতে হবে না।'
'এবারের পাত্রটা সত্যিই ভালো ছিল। আমাদের দাওয়াত দিলেও বিয়েটা হত।'
'তুই কি করে এতটা নিশ্চিত?' ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করলেন মিষ্টির মা।
'ছেলেটা আমার বান্ধবীর প্রাক্তন প্রেমিক ছিল।' মিষ্টির হাসি মুখের উত্তর।
রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন মিষ্টির মা। মিষ্টি আবার চুপচাপ হয়ে বসে রইলো।
মিষ্টির খালাতো বোনের আগের সম্বন্ধটা ভাঙ্গার পর্যাপ্ত কারণ ছিল। ছেলে পক্ষের বিশাল আবদার, কিন্তু তারা এটাকে যৌতুক বলে কোনোভাবে স্বীকার করতে রাজি নন।
মিষ্টি ছেলের বাবা'কে বলেছিলো, 'আপনার ছেলেটা কত ক্যারেটের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি যে তার সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে হলে এত শত শর্ত পূরণ করতে হবে?'
এতটুকু কথায়'ই সেদিন সম্বন্ধ'টা ভেঙ্গে যায়। দায় চাপে মিষ্টির উপর। যার কারণে পরবর্তীতে মেয়ের বিয়ের দাওয়াতটাও দেননি মিষ্টির খালা।
ঐশি এসে পাশে বসলো।
'আপা শুনেছিস, আগামীকাল বড় ফুফুর ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে যাবে। ভাইয়া তোকে আর আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।'
'ফুফু রাজি হলো?'
'না হয়ে আর উপায় কি!'
পরদিন ছেলে পক্ষের সঙ্গে মিষ্টি মেয়ে দেখতে হাজির হয় মেয়ের বাড়িতে। মেয়ে দেখতে আসার অভিজ্ঞতা পূর্বে তার নেই। এবারই প্রথম।
মিষ্টির দিকে তাকিয়ে হেসে মেয়ের মা বললেন, 'কি নাম তোমার?'
'মিষ্টি।'
'বাহ্! দেখতেও মিষ্টির মত তুমি।'
'কিন্তু ভেতরটা নিম ফল ভর্তি আস্ত একটা নিম গাছ।' পাশ থেকে বিড়বিড় করে বললেন মিষ্টির বড় ফুফু।
কথায় কথায় মেয়ের মা বুলি ছাড়েন, 'অনেক অনেক সম্বন্ধ আসে আমার মেয়ের জন্য। কিন্তু ঠিকঠাক পছন্দ হয় না। আমি তো বলেই দিয়েছি, বিসিএস ক্যাডার ছাড়া মেয়েকে বিয়েই দিব না৷ আমার মেয়ে আবার ছেলে দেখতে ভালো না হলে বিয়ে করবে না৷ মেয়ের বাবার চাওয়া হলো, সামাজিক মর্যাদায় ও ক্ষমতায় ছেলের পরিবারের নাম-ডাক থাকা চাই। এই তিনটে জিনিসের মিলন আমরা একজনের মাঝে খুঁজেই পাচ্ছিলাম না বলে এতদিন বিয়েটা দিতে পারিনি।'
মেয়ের বাবা হেসে বললেন, 'আপনাদের ছেলেকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। এই সম্বন্ধ'টা একেবারে ঠিকঠাক আমাদের জন্য।'
মিষ্টির ফুফু হেসে বললেন, 'তাহলে কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক।'
কিন্তু বাধ সাধে মিষ্টি।
'আপনার মেয়ের জন্য সুদর্শন ছেলে চাই, বংশগতিও ভালো চাই, বিসিএস ক্যাডার চাই। তো এরকম একজন ছেলে আপনার মেয়েকে কেন বিয়ে করবে? তারও তো কিছু কারণ থাকা চাই।'
মেয়ের পরিবারের হাসি মুখগুলো নিমিষেই চুপসে গেল।
মেয়ের বাবা বললেন, 'আমার মেয়ে যথেষ্ট সুন্দরী এবং সে পড়াশোনা করছে। সামনে নিশ্চয়ই ভালো কিছু করবে। আর না করলেওবা কি! ছেলের এত অর্থসম্পদ থাকতে মেয়েকে কিছু করতে হবেওবা কেন!'
'আফসোস! তবুও আপনারা একজন ভালো মানুষকে খুঁজলেন না। ছেলের চরিত্র খারাপ হোক কিন্তু দেখতে ভালো না হলে বিয়ে হবে না। ছেলের পরিবারের মন-মানসিকতা হোক নিচু কিন্তু অর্থবিত্তে সমাজে তাদের স্থান উঁচু না হলে সে সম্বন্ধ বাতিল। বিয়ের পরে ইচ্ছে খুশি মত বউ পেটাক কিন্তু ছেলে বিসিএস ক্যাডার না হলে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ালো না?'
মুখ খুললো এবার ছেলে নিজেই, 'যে পরিবারের মানুষ একটা ছেলেকে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য, ডিগ্রি আর তার পরিবারের অবস্থান দিয়ে যাচাই করে, সে পরিবারে আত্মীয়তা করার ইচ্ছে আমাদের নেই।'
মিষ্টির ফুফু বিয়ে না হওয়ার সব দায় চাপায় মিষ্টির ঘাড়ে। এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তার। হাসিমুখে বলে, 'তোমাকে শিঘ্রই একটা লক্ষ্মী মেয়ে খুঁজে দিব।'
মিষ্টির ফুফু মুখ ভেংচি কাটেন।
'আমার ছেলের জন্য মেয়ে আমি এমনিতেই পেয়ে যাব। তুই তোর জন্য পারলে ছেলে খোঁজ।'
আনমনা হয়ে ভাবতে থাকে মিষ্টি। মুখে তার অস্পষ্ট হাসির রেখা।
'এত মানুষের ভীড়ে একটা ঠিক মানুষ খুঁজে বের করা খুব কঠিন হলেও আমি অপেক্ষা করবো। তবুও ভুলে ডুব দিতে রাজি নই।'
।