ছোট্টবেলায় বানরওয়ালা খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে
হাতের কবজি নাড়িয়ে ফেললাম। সারাদিন লুকিয়ে রইলাম। আম্মা টের পেলে আর আস্ত রাখবেন না।
মারা তো মারবেনই আব্বার কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে কি যে নালিশ করবেন কে জানে । অথচ আম্মাকে কে বোঝাবে, কাঠি হাতে গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে বানরের মতো ছুটে বেড়ানোর কি মজা! যাকে ছুঁয়ে দেবো, সেই বুড়িবানর হবে। সে আবার কাঠি হাতে ছুটবে, আমাদের ছুঁয়ে দিতে। আমরা এডাল থেকে ও ডালে লাফিয়ে পালাবো।
আজ লাফ দিয়ে যে ডালটা ছুঁতে চেয়েছি। সেটা ডাল না ঘন পাতার আড়াল, ঠিক মনে হয়েছিলএকটি শক্ত সামর্থ ডাল। আড়ালে যে ডাল নেই কে জানতো? সব দোষ বুঝি আমার?
আম্মার চেয়ে আব্বা নরম মনের মানুষ। আশায় আছি
আজ যদি আব্বা বাড়ি আসেন, আমায় না দেখতে পেয়ে খুঁজতে বের হবেন। তাহলেই রক্ষা উনি সোজা কাঁধে তুলে আমায় বাড়ি নিয়ে যাবেন। আমার হাতে থাকবে আব্বার আনা কাঠি লজেন্স। মুখে দিলেই যার রষ গড়িয়ে পড়বে আব্বার কাঁধে। আব্বা অবশ্য এই নিয়ে কিছু বলবেন না।
আম্মাই গজগজ করতে থাকবেন ' হ্যায় হইছে রুপচান বাদশা আর তার পোলায় হইছে ডালিমকুমার।
তারা সারাদিন সাইজাগুইজা ঘুইরা বেড়াইবো। আমার
কাম খালি রান্ধন বাড়ন আর তাদের কাপড় ধোয়ন।
যেদিন আব্ববা আসেন, রাত্রে আম্মার রাঁধতে অনেক সময় লেগে যায়। উনি আনেন সামুদ্রিক বড় বড় মাছ।
খাশির রান। গরুর গুর্দা। বন মোরগ। সবই সেদিন
রান্না হওয়া চাই। আমার আব্বা আসলে একজন জাহাজের ব্যবসায়ী। উনারা কয়েক বন্ধু মিলে পুরাতন জাহাজ কিনে নিয়ে সেটা কেটে কেটে বিক্রি করেন।
নিজেদের কিছু করতে হয়না। ছোট ব্যবসায়ীরা এসে
মালামাল নিয়ে যায়। উনার কাজ শুধু তদারকি। লোকজন আজকাল খুব ফাঁকিবাজ হয়েছে। আব্বা
একদিন না থাকলেই অনেক লস। তাই আব্বা খুব কম আসেন।
আজ আমার ভাগ্য সত্যিই খারাপ। বড় আপা আর আম্মা টর্চ নিয়ে আমায় খুঁজছেন। এদিকে আমার হাত ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। নড়ার শক্তি নেই। বড় আপাই
আমায় প্রথম দেখলেন। উনি চিলের মতো দৌঁড়ে এসে আমায় ধরলেন। আমি ভয়ে আর শীতে কাঁপছি। আমার বয়স তখন দশ। আম্মা চিৎকার দিয়ে বললেন।
' ও হাতে ক্যান ব্যথা পাইছে ওর পায়ে কিছু হয় নাই?
ঠ্যাঙ ভাইঙ্গা ঘড়ে পইড়া থাকলে শান্তি পাইতাম। আমার জ্বালা জুড়াইতো। ' শেষের দিকে আম্মার গলা ধরে এসেছে আমি টের পেলাম।
আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আমিও বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই।সমুদ্রে সমুদ্রে নাবিক হয়ে ঘুরবো। আর ঘরে ফিরবো না। আম্মা হাজার কাঁদলেও না। বিধাতা সেদিন মুচকি
হাসলেন।
ক্লাস সিক্সে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। আমার স্বাস্থ্য
বরাবরই ভালো। যতো দুষ্টুমিই করি পড়াশোনায় খুব ভালো ফল করতাম। আব্বা একদিন আমার হাত ধরে বললেন ' চলো আব্বা, একটা পরীক্ষা দিয়া আসবা। কলম টলম কি লাগবে নিয়া নাও। আমি আব্বার সাথে লক্ষ্মীপুর থেকে চিটাগাং চলে এলাম।
আমার খুশি দেখে কে? খুব বড় একটা বিল্ডিংএ আমাদের পরীক্ষা হলো। সবাই দেখছি খুব সিরিয়াস। অনেকেই জ্যামিতির সুত্রগুলো আউড়ে নিচ্ছে। কেউ ইংরেজী গ্রামার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। আমি চুপচাপ সবাইকে দেখছি। আব্বু আমাকে নতুন একটা শার্ট কিনে দিয়েছেন। সেই শার্টে কলমের দাগ লেগে যায় কি-না, আমি এই ভাবনাতেই বিভোর।
বাড়ি আসার সাতদিন পরে আব্বা এসে হাজির। মুখ শুকনো। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছেন। আব্বা শুয়ে থাকার মানুষ না। আম্মা পান বানিয়ে দিলেন। উনি ছুঁয়েও দেখলেন না। শুধু বড় আপাকে বললেন। 'ছেলেটাকে আর একবার পরীক্ষায় ডাকছে । '
আব্বা খুব ভোরে উঠে নামাজ পড়ে বড় বড় সূরা কেরাত করে পড়েন। উনার কোরআন পড়ার শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। আমরা হাতমুখ ধুয়ে অজু শেষে নামাজ আদায় করে পড়তে বসি। এটা বহুদিনের অভ্যাস।
আজ নামাজ শেষে আব্বার সাথে আবারো চিটাগাং
রওনা হলাম। আমার পায়ে নতুন কেডস, সাদা শার্ট প্যান্ট। আমার গায়ের রঙ আর চেহারা নিয়ে অন্য ভাইবোনদের সামান্য ঈর্ষা আছে। আজ বড় আপা
আমার কপালে চুমু খেলেন। বারো বছরের আমি লজ্জায় লাল হলাম। আজো অনেকে এসেছে। আমার মতোই বয়স। একজন দেখলাম ভয়ে রীতিমত কাঁপছে। আমায় জিজ্ঞেস করলো ' তুমি কি এবারই প্রথম না দ্বিতীয়বার? আমি উত্তর দেবার আগেই।
মিলিটারি টাইপের দুজন এলো। আমরা ভয়ে চুপ হয়ে গেলাম।
ভাইভা বা মেডিকেল যাই বলা হোক। আমি পাশ করে গেলাম। তারা একটা কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
কয়েকদিন পরে আব্বা আবার বাড়ি এলেন। আম্মাকে কি একটা বলতেই আম্মা চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। আম্মা বকছেন প্রয়োজনে পিঠে দু'চার ঘা
লাগাচ্ছেন, সেটা সইতে পারি। কিন্তু আম্মা কাঁদছেন
এটা সইতে পারি না। বড় আপা আচার খেতে দিলেন
আস্ত এক পিরিচ। যা আমার জন্য একেবারে নিষিদ্ধ।
তারপর টেবিলে বসে পা দোলাতে দোলাতে বললেন
'তুই তো আমাদের ভুলেই যাবি। রুনু তখন ক্লাস টু
আর রায়হান মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
আমি এক সকালে দুরুদুরু বুকে একটা ব্যাগ হাতে
ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজের গেটের ভেতরে পা রাখলাম। পেছনে আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পিছনে ফিরে তাকানোর সাহস নেই। আমি ভাঙা অন্তরের সাথে বুক টান করে ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমি জানি চার ভাইবোনের মাঝে আব্বার আমার প্রতি একটা আলাদা টান আছে।
শুরু হলো আমার নতুন জীবন। প্রতিমাসে প্যারেন্টস ডে তে আব্বা আসেন। হাতে নানারকম খাবার। আমার জন্য পোষাক। সব রেখে আমার আব্বার শার্টের ভেতরের বুকের উষ্ণতাটুকুর জন্য মন কাঁদে। কিন্তু আমি একজন ক্যাডেট। নাম ক্যাডেট জুহায়ের। আমার একটা নাম্বার আছে।
আমরা একটা রঙের মাঝে ভাগ হয়ে যাওয়া গুটিকয়
শক্ত পোষাকের আড়ালে 'মায়ের কোল আর বোনের
জামার খুঁট ছেড়ে আসা শিশু। আমরা জানি কিভাবে
নিজের বিছানা পরিষ্কার রাখতে হয়। নিজের বেল্ট কি করলে আরো চকচকে থাকবে। আমাদের জুতো
আয়নার মতো চকচক ঝকঝক না করলে আমাদের ভাগ্যে শাস্তি নির্ধারিত। শব্দ করে খাওয়া বা সিনিয়রদের আগে খাবার নেয়া এখানে পাপের সামিল। আমি একজন কেতাদুরস্ত ক্যাডেট।
বহুদিন জোনাকি দেখি না। মালাই আইসক্রিমের স্বাদ ভুলে গেছি। আচ্ছা হজমি খেলে কি এখনো জিভ কালো হয়?
ছয়মাস পরে বাড়ি ফিরলাম। বড় আপার এসএসসি শেষ। সে এখন কলেজে পড়ছে। রায়হান এখনো স্কুলে যেতে কেঁদে বুক ভাসায়। আব্বা লক্ষ্মীপুরে বড় একটা ওষুধের ফার্মেসি দিয়েছেন। সেখানে দাঁড়ালেই দুটো
সিভিট পাওয়া যায়। আব্বা ফার্মেসিতে বসেন না।
আমাদের একজন ম্যানেজার আছে। উনি শক্ত মুখ করে ফার্মেসিতে বসে থাকেন।
ছয়টি বষন্ত ও বর্ষা শেষে একদিন ক্যাডেট কলেজের বাইরে পা দিলাম। আজ চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।
যেন এটাই আমার ঘরবাড়ি ছিল। যেই মাঠে শাস্তি স্বরুপ বহুবার ডিগবাজি দিয়েছি। ক্যাডেটের ভাষায় যাকে বলে ফ্রন্ট রোল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল সব ফেলে আবার ওই মাঠে ডিগবাজি দেই আর বলি।
'আমায় আরো একবার শাস্তি দাও। এই মাঠ, এই দালান, হোস্টেলরুম, ক্যান্টিন, স্কুল বিল্ডিং কলেজ বিল্ডিএ আমি শিশু, থেকে, বালক হয়েছি, বালক থেকে
কিশোর, আজ আমি আঠারোর তরতাজা যুবক।
আমার শৈশব আমার কৈশোরকে কেড়ে নিও না। আর
কিছুদিন সময় দাও ।
এই আমি ক্যাডেট 'জুহায়ের' হাঁটছি আর ভাবছি। একদিন ওই মস্ত দালানে বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমি কেঁদে কেঁদে ভেবেছিলাম।
'কি আশ্চর্য বৃষ্টি সারাদিন। অথচ আমার ছোঁয়ার অধিকার নেই। কাগজের নৌকার মতো আমিও বৃষ্টি ছুঁতে ভয় পাই।
কাঁধে ব্যাগ আর হাতে স্যুটকেস নিয়ে বাইরে আসতে আসতে ভাবছি, আমি সেই ফিলিস্তিনি শিশু, যে তার স্কুলের খাতায় লিখেছিল ‘ খরগোসের ঘর আছে আমার কোন ঘর নেই। পাখির বাসা আছে আমার বাসা নেই।
দেশান্তরী কবি ‘মাহমুদ দারবীশ ‘ লিখেছিলেন আমার ঠিকানা আমার এই সুটকেস। কেন যেন আমার নিজেরো মনে হচ্ছিলো। আমার বর্তমান ঠিকানা আমার এই সুটকেস। জানি না সেটা কোথায় রাখার একটু জায়গা পাবো।
কিছুক্ষণ পরে ধুপধাপ রাত নামে। রাত অন্ধকারের রাজত্ব। অন্ধকারের সবচেয়ে বড় গুণ এই যে, কোন কিছু খুঁটিয়ে দেখা যায় না। তাই মানুষের চোখের জলের মত দৈনতা সহজেই লুকিয়ে ফেলা যায়।