গলায় কেমন যেন একটা অদ্ভুত ছোঁয়া অনুভব করে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ঘুম অবস্থাতেই গলায় হাত ঘষে একবার চোখ মেলে তাকালাম। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে এবারে ঠোঁটে কে যেন চুমু খেলো। আমি এক ঝটকায় উঠে বসে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে চারপাশে তাকালাম।
কেউ নেই।
রুমের দরজা জানালাও বন্ধ। জানালার বাইরে একটা নাড়িকেল গাছ আছে। ঝড়ের বাতাসে গাছটার পাতা জানালার কাঠে ঠকঠক করে শব্দ করছে। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার ব্যাটারীর পাওয়ার শেষ। কাঁটাগুলো একই স্থানে খচখচ করছে আর সময় দেখাচ্ছে ১০টা ৫।
...মোবাইলে সঠিক সময় রাত ২ টা ৪৪
আমি উঠে লাইট জ্বালিয়ে এক গ্লাস জল নিলাম। গ্লাসের জলে ঠোঁট ছোঁয়াতেই জলে রক্তিম কোনো পদার্থ চোখে পড়লো।
আমার ঠোঁট কেটে গেছে!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি ঠোঁট থেকে রক্ত ঝড়েছে অল্প। একটা আঘাত চোখে পড়ছে। হয়তো কোনোভাবে দাঁত লেগেছে।
একটা টিস্যুপেপার নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে খেয়াল হলো, আমার গলায় বেশ অদ্ভুত কিছু দাঁতের দাগ!
আমি টিশার্টের গলা টেনে দেখলাম শুধু গলায় না। আমার বুকেও দাঁতের কামরের লাল চক্রাকার ছোপ।
কী আশ্চর্য্য!
ঘড়ির শব্দটা আচমকা বদলে গেছে। চলতে শুরু করেছে ওটার সেকেন্ডের কাঁটা। সময় এগিয়ে চলছে দশটা ৫ থেকে সামনের দিকে। আমি টিশার্ট খুলে বুকে পিঠে আর কোনো দাগ চোখে পড়ে কি না দেখছি। আর কোনো দাগ নজরে আসছে না। প্যান্ট টেনেটুনেও সবখানে এক নজর দেখে নিলাম ঠিকঠাক আছে কি না।
সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে।
ঠোঁটের আঘাত না হয় আমার দাঁতে লেগে হতেই পারে, কিন্তু আমার গলায় আর বুকে আমি নিজেই দাঁত বসাবো -তা অসম্ভব।
ভাবতে ভাবতে আয়নায় ঝুঁকে ঠোঁটের আঘাতটা দেখছি, এমন সময় আয়নার মধ্য দিয়ে দেয়ালের ঘড়িটায় চোখ পড়লো। আয়নার প্রতিবিম্বের মধ্যে দেখা যাওয়া ঘড়িটার কাঁটা ১০ টা ৫ এ ঠাঁই আঁটকে আছে এখনও...
...অথচ ঘরের দেয়ালে ঝোলানো বাস্তবিক ঘড়িটা সামনের দিকে চলছে!
(২)
আয়নার প্রতিবিম্বের মধ্য দিয়ে যে ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে, ওটার কাঁটা ১০ টা ৫ এ আঁটকে এক স্থানেই কাঁপছে। অথচ ঘরের দেয়ালে ঝোলানো বাস্তবিক ঘড়িটা সামনের দিকে চলছে!
এটা কী করে সম্ভব?
আমি আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম।
মধ্য রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আমার মস্তিষ্ক হয়তো অযৌক্তিক চিন্তা ভাবনা করছে। আমি চোখ বন্ধ করে কয়েক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে মনকে স্থির করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মন অস্থির হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরটা ছটফট করছে চোখ খুলে দেখার জন্য।
আমি নিজেকে বুঝালাম, এ রুমে আর কারো আসা সব রকম যুক্তিতেই অসম্ভব।
দরজা বন্ধ।
জানালা বন্ধ।
কোনো চোর ডাকাত আসার সুযোগও নেই। এ বয়সে ভূত প্রেতের ভয় পাওয়াটা হাস্যকর।
আমি প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে এক থেকে একশ বিশ অবধি গুনলাম। দু’মিনিটেও অস্বস্তি দূর হলো না। আরেক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
লাইট জ্বালিয়ে রেখেছি। বিষয়টা নিজের কাছেই হাস্যকর লাগছে। জানালার কাছে নারিকেলের পাতা ঠকঠক শব্দ করছে, আঁচড় কাটছে। বাতাসের শো শো শব্দ হচ্ছে। দেয়ালের ঘড়ি চলছে। সময় দেখাচ্ছে দশটা বেজে ১০মিনিট।
আমি মোবাইলের পাওয়ার বাটন চেপে ডিসপ্লে অন করলাম।
আশ্চর্য!
মোবাইলে এখনো সময় দেখাচ্ছে ২ টা ৪৪!
অমন সময়ে জানালায় একটা বিকট শব্দ হলো। কেউ একটা লাঠি দিয়ে আঘাত করার মতো শব্দ। আমি চোখ বন্ধ করে কয়েক মিনিট শুয়ে থাকলাম। অস্বস্তি লাগছে। পরপর তিনবার জানালায় একই শব্দ হলো। হয়তো গাছের কোনো একটা ভারী অংশ বাতাসে আলাদা হয়ে জানালার কাছাকাছি কোথাও ঝুলছে।
অস্বস্তি কাটিয়ে একটু স্বাভাবিক হওয়ার জন্য আমি উঠে জানালা খুললাম। বাতাসের প্রচণ্ড এক ধাক্কায় সারা ঘরের সব জিনিসপত্র ঝুমঝুম শব্দে নড়ে উঠল।
যা ভেবেছিলাম তা-ই।
একটা নারকেল গাছের ডাল ভেঙ্গে উপরে কোথাও একটা আটকেছে। আর ডালের বটুটা জানালার সামনেই বাতাসের তোড়ে এদিক ওদিক নড়ছে।
আমি সাবধানে জানালা বন্ধ করে ড্রয়ার থেকে একটা কাঁথা বের করলাম। একটু শীত শীত করছে। কাঁথা ঝেড়ে বিছানায় ছুঁড়ে রেখে লাইট অফ করতেই আয়নার দিকে চোখ গেল।
আমি লাইট জ্বালিয়ে আবার নিভালাম। কিন্তু কোনোবারেই অদ্ভুত ভাবে আয়নায় এ ঘরের যে প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে, সেখানে আলো নিভছে না।
আমি লাইট জ্বালিয়ে রেখে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম...
(৩)
ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলেও আয়নার মধ্য দিয়ে এ ঘরের যে প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে, সেখানে আলো নিভছে না। আমার মস্তিষ্কে অস্বস্তিকর ভ্রম হচ্ছে। হয়তো আমি এখনো ঘুমিয়ে আছি। ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নে এসব অদ্ভুত বিষয় দেখতে পাচ্ছি।
কিন্তু স্বপ্ন কখনোই এতটা স্পষ্ট হতে পারে না।
স্বপ্ন হয় অস্পষ্ট।
এ ঘরের প্রত্যেকটা বস্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আয়নায় আমার প্রতিবিম্বকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। স্বপ্নে নিজের হৃদস্পন্দন টের পাওয়া যায়? আমি পাচ্ছি।
আমি আয়নার সম্মুখে এসে দাঁড়ালাম।
আমার কি এ মুহূর্তে এ আয়নাটা ঢেকে দেয়া উচিত?
হঠাৎ থমকে গেলাম। এমন বোকা বোকা চিন্তা কেন করছি আমি? প্রাইমারি স্কুলে পড়া বাচ্চার মতো আয়নাকে ভয় পাচ্ছি। সকালে ঘুম ভাঙার পর নিজের কাছেই সবকিছু হাস্যকর মনে হবে।
আমি আয়নার সামনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে শো শো শব্দ করে ঝড়ো বাতাস জানালায় ধাক্কা দিচ্ছে। জানালার কড়ায় খটখট শব্দ হচ্ছে। সেকেন্ডের কাঁটার ছক ছক শব্দে ঘড়িও এগিয়ে চলছে। আয়নার মধ্য দিয়ে যে ঘড়ি দেখা যাচ্ছে, তা চলছে কি না দেখার আগ্রহ এড়িয়ে গেলাম।
খাটে রাখা মোবাইলে হঠাৎ একটা ফোনকল এলো।
আমি মোবাইল হাতে নিয়ে ডিসপ্লেতে তাকিয়ে এক মুহূর্ত থমকে গেলাম। অদ্ভুত একটা নম্বর থেকে কল এসেছে। আমি রিসিভ করে ‘হ্যালো' বললাম। ওপাশ থেকেও আমার কণ্ঠস্বরে হ্যালো শোনা গেলো। আমার কথা আমিই শুনতে পাচ্ছি।
আমি আবারও বললাম, ‘কাকে চাই?’
যা ই বলছি, ওপাশ থেকে প্রত্যেকটা কথা আমিই শুনতে পাচ্ছি। আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
বিরক্ত হয়ে কলটা রেখে দিতেই খেয়াল হলো, মোবাইলের ঘড়িতে এখনো সময় ২ টা ৪৪!
অথচ দেয়ালের ঘড়িটা আরও পনেরো মিনিট এগিয়ে ১০ টা ২৫ দেখাচ্ছে। শেষ যে কলটা এসেছে তার কল ডিউরেশনও শূণ্য সেকেন্ড!
মানে, সময় কি একটুও বাড়ছে না?
আশ্চর্য একটা বিষয় চোখে পড়লো। যে নম্বর থেকে এ মাত্র কল এসেছে, সে নম্বরটা আমারই নম্বর, তবে শেষ ডিজিট থেকে প্রথম ডিজিটে উল্টো করে লেখা।
আমার এ মুহূর্তে আর কাউকে ফোন করে এ বিষয় জানানো উচিত।
মিহিকে কল দিলাম। ফোন যাচ্ছে, রিসিভও হলো। কিন্তু সময় ০.০০ মিনিট থেকে এক সেকেন্ডও সামনে এগুচ্ছে না! ডেটা কানেকশন অন করার চেষ্টা করলাম। ডেটা ট্রান্সফারের কোনো সিগনাল দেখাচ্ছে না।
ফোনটা রেখে আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রতিবিম্বে দেখা যাওয়া ঘড়িতে তাকালাম। ও ঘড়িটার কাঁটা এখনো দশটা ৫ এর ঘরে আটকে নড়ছে!
আমার সাথে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। এর কোনো ব্যাখ্যাও আমার কাছে নেই।
...হঠাৎ আমার প্রতিবিম্বে চোখ পড়লো!
আমি যেখানটায় আছি ঠিক ততখানি দূরত্বে আমার প্রতিবিম্ব থাকার কথা।
কিন্তু নেই!
আমার প্রতিবিম্ব আরও অনেকটা দূরে টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটায় আলাদা কোনো স্বত্ত্বার মতো বসে হাসছে!
(৪)
আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব দূরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে সামনে এলো। এসে ঠিক সমদূরত্বে আমার সামনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল।
আমি যেন একটা ধাক্কা খেলাম!
এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে আবার তাকালাম।
সব স্বাভাবিক লাগছে।
আয়নাটায় একবার হাত রাখলাম। স্বাভাবিক ক্রিয়া প্রতিবিম্বেও ঘটলো। আমি হাত সরিয়ে নিয়ে একটু স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিয়ে সরে এলাম।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে আবার পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি, আমি সরেছি ঠিকই, কিন্তু আমার প্রতিবিম্ব ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে!
আমি আবার আয়নার সামনে এলাম। প্রতিবিম্ব আয়না থেকে হাত সরিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে হাসলো। আমি অপলক চোখে তাকিয়ে আছি। প্রতিবিম্ব এক মুহূর্ত সময়েই দু'হাতে নিজের মুখের চোয়াল বিপরীত দিকে টেনে উপর-নিচে চিড়ে ফেলল!
চোখ বন্ধ হওয়ার আগে আমি লক্ষ্য করলাম, আমার গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে সারা আয়না আর মেঝে রক্তিম হয়ে গেছে। আমার চোয়াল ঝুলে পড়েছে। আমি মেঝেতে পড়ে যাবার আগেই সব আঁধার হয়ে গেলো...
গলায় অদ্ভুত ছোঁয়া অনুভব করে আতংকে জেগে উঠলাম। ঘুম ঘুম অবস্থাতেই গলায় হাত রেখে একবার চোখ মেলে তাকালাম।
তবে কি সব স্বপ্ন ছিল?
ক্লান্তি জড়িয়ে আবার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। চোখ বুজতেই কিছু সময় আগের মতো একই অনুভূতি হলো। ঠোঁটে কেউ চুমু খেয়েছে। আমি এক ঝটকায় উঠে বসে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে চারপাশে তাকালাম।
কোথাও কেউ নেই!
একটু আগে ঘটে যাওয়া অবাস্তব ঘটনাগুলো থেকে মুক্তি মনকে শান্তি দিচ্ছে। রুমের দরজা জানালা বন্ধ। বেলকনি দরজায়ও ছিটকিনি টানানো। বাইরে নারিকেল গাছটার পাতা ঝড়ের বাতাসে জানালার কাঠে ঠকঠক করে শব্দ করছে। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটা ১০টা ৫ এ আটকে আছে কাঁটাগুলো একই স্থানে খচখচ করছে নড়ছে।
আমি মোবাইলে সময় দেখলাম।
আশ্চর্য!
স্বপ্নের মতো বাস্তবেও এখন সময় রাত ২ টা ৪৪!
আমি উঠে লাইট জ্বালিয়ে এক গ্লাস জল নিয়ে গ্লাসের জলে ঠোঁট ছোঁয়াতেই জলে অল্প রক্ত ছড়ালো...
আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত! তবে কি সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যুপেপার দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে গলায় আর বুকেও দাঁতের দাগের নিশ্চয়তা পেলাম।
এ দাগগুলো কীভাবে হয়েছিল?
আচমকা ঘড়ির শব্দ বদলে গেল। চলতে শুরু করেছে ওটার সেকেন্ডের কাঁটা। সময় এগিয়ে চলছে দশটা ৫ থেকে সামনের দিকে।
এ প্রত্যেকটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন আমার মাথায় প্রচণ্ড পীড়া দিচ্ছে।
আমি আয়নার প্রতিবিম্বে দেয়ালের ঘড়িতে তাকালাম। ঘড়ির কাঁটা ১০ টা ৫ এ ঠাঁই দাঁড়িয়ে কাঁপছে!
প্রত্যেকটা ঘটনা আগের মতো ঘটছে। তার মানে আবারও একই পরিণতিই কি হতে যাচ্ছে?
আমার কি ঘটনার পরিবর্তন করা উচিত?
ব্যতিক্রম করা উচিত আগেরবারে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তি কাটানোর জন্য খাটে বসে এক থেকে গুনতে শুরু করে থমকে গেলাম।
আমার ভিন্ন কিছু করা উচিত।
আমি একশ বিশ থেকে এক পর্যন্ত উল্টো গুনে এলাম। সময় ২ মিনিট থেকেও অনেক বেশি লাগলো। তবুও মন তুলনামূলক স্থির হয়েছে।
মোবাইলে সময় এখনো ২ টা ৪৪!
জানালার বাইরে ছেড়া নারকেল পাতার গোড়াটা আঘাত করলো। আমি জানালা খুলে দমকা বাতাস আসতে দিলাম। সারা ঘরের সব জিনিসপত্র ঝুম করে নড়ে উঠলো বাতাসের ধাক্কায়।
পাতাটা সরিয়ে দিয়ে জানালা বন্ধ করলাম না। একটা সিগারেট ধরালাম। বাইরে ঝড়। সে ঝড়ের হাওয়া মুখে আঁছড়ে পড়ছে। রাস্তা, বিল্ডিং, গাছপালা, পিলারে টানানো ইলেক্ট্রিসিটির তার -সবকিছু অন্যরকম দেখাচ্ছে।
সিগারেট দ্রুত পুড়ে গেল।
আমি লাইট জানালা বন্ধ করলাম না। ঘরের কাগজপত্র সব এর মধ্যেই এলোমেলো হয়ে গেছে। মোবাইলে একটা কল এসেছে। আমি ধরিনি। কে করেছে সেটা দেখার চেষ্টাও করিনি।
যদি সে একই নম্বরই দেখা যায়!
গ্লাসে জল ঢেলে আয়নার দিকে ফিরে তাকালাম। আর কিছু ভাবার আগে আমার এ আয়নাটা ঢেকে দেয়া প্রয়োজন।
সব ঘটনা যেমন ঘটেছিল, আমি তা পরিবর্তন করে ফেলেছি। আমি শুধু নিশ্চিন্ত হতে চাই। ভোরের আলো দেখার তৃষ্ণা আমাকে অধৈর্য্য করে রেখেছে।
আমি জলের গ্লাস হাতে সামনে এগিয়ে এলাম। গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে নিউজপেপার আর গ্লু হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো, আয়নার মধ্যেকার আমার হাতে জলের গ্লাস।
আমি পেছনে সড়ে এসে মেঝেতে পড়ে গেলাম। আয়নার মধ্যেকার আমার প্রতিবিম্ব এখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে!
হঠাৎ মেঝেতে গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে কয়েক টুকরো করে ফেলল ওটার। তারপর কাঁচের ভাঙা গুড়ো মুখের পুরে নিয়ে চিবুতে লাগল!
আমি বিষ্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকালাম!
ওর মুখ গলা কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড ব্যথায় আমার মুখ, গলা আর বুক চিড়ে যেতে শুরু করল!
আমি উবু হয়ে বসে মেঝেতে শ্বাসহীনভাবে তাকিয়ে আছি। আমার ছিন্নভিন্ন মুখ থেকে অনর্গল কালচে রক্ত বেরিয়ে আসছে...
(৫)
আয়নার মধ্যে আমার প্রতিবিম্ব কাচের ভাঙা টুকরোগুলো মুখে নিয়ে চিবুতে শুরু করলো। আমার মুখ, জিব, গলা কেটে অনর্গল রক্ত বেরুচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ আমাকে খুব ধীরে জবাই করছে। আমি মেঝেতে পড়ে অনবরত ছটফট করছি। ভয়ানক কষ্টে আমার ভেতরের সব কিছু খুবলে যাচ্ছে।
বালিশে মাথা গোঁজা অবস্থায় ছটফট করতে করতে চোখ মেললাম। গলায়, মুখে, বুকে হাত দিয়ে দেখছি -সব ঠিক আছে।
কিন্তু আমার সাথে এসব কী হচ্ছে?
অস্বস্তি আর ক্লান্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করতেই ঠোঁটে সেই একই ছোঁয়া পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। অন্ধকার। তবুও আমি কাউকে দেখছে পাচ্ছি। কেউ একজন আমার ঠিক সামনে পা মুড়িয়ে বসে আছে।
আমি যথেষ্ট শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’
আমার সামনে বসা মানুষটা মুখ উঁচু করে আমার দিকে তাকাল। তারপর এক পলকে মিলিয়ে গেল!
আশ্চর্য!
আমি কি কোনো ঘোরে আছি?
মাথার ভেতরে দপদপ করছে।
ভয়ানক টনটন করছে মাথার দু'পাশের রগ।
আমি বালিশের পাশে হাত রেখে মোবাইলটাকে বরাবর জায়গায় পেলাম না। ওটা পাওয়া গেল বিপরীত পাশে। এ মুহূর্তে ফোনের ডিসপ্লে অন করলেই সময় চোখে পড়বে। আমি এখন সময় দেখতে চাইছি না।
আমি উঠে দাঁড়ালাম।
প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় সবকিছু এলোমেলো লাগছে। ঘরের বাতি জ্বালাবার সুইচ অবধি পাচ্ছি না। টেবিলের সামনে এসে লাইটারটা হাতের কাছে পেলাম। আগুন জ্বালিয়ে সুইচ খুঁজে বের করে বাতি জ্বাললাম।
প্রথমেই মেঝেতে ছিটিয়ে পড়ে থাকা এক গাদা রক্ত চোখে পড়ল। আমি খাট থেকে নেমে যেদিকে যেদিকে গেছি, লক্ষ্মীর পায়ের মতো রক্তের ছাপ এঁকে আছে।
আমি দ্রুত আয়নার দিকে তাকালাম।
অবাক কাণ্ড!
আয়নাটা ওখানে নেই। আয়নার ফ্রেমে একটা কালো কাচ দেয়ালে আটকে আছে!
কোথাও গ্লাস খুঁজে পেলাম না। জলের জগ থেকে গটগট করে জল খেয়ে চেয়ারে শান্ত হয়ে বসে চোখ বন্ধ করলাম। মাথার ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। যেন ভেতর থেকে কেউ একজন টোকা দিয়ে বলছে, ‘তুই এখুনি মরে যা!’
বাইরে বাতাসের শব্দ হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা একস্থানে আটকে থাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার চোখ তুলে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।
তাকিয়ে কী দেখব?
প্রত্যেকটা বিষয় আমার সাথে একই চক্রাকার পথে ঘটেই চলছে!
জানালায় শব্দ হলো।
আমি স্থির বসে রইলাম। আরও কয়েকবার শব্দ হলো। আমি নড়লাম না। ওভাবেই বসে রইলাম। জগতের যাবতীয় সব বিষয় আমার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে আমার শেষ মুহূর্ত অবধি এখানেই চোখ বন্ধ করে বসে থাকি।
জানালায় অনবরত শব্দ হতে শুরু করলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কড়া পাচ্ছি না। মাথা ব্যথায় সোজা দাঁড়ানোরও জো নেই!
কোনো রকমে জানালা খুলে নারিকেলের পাতাটা সরিয়ে বাতাসে দাঁড়ালাম।
উন্মত্ত বাতাসে একটু শান্তি লাগছে।
আমি টেবিলের উপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার হাতে নিয়ে সিগারেট ধরালাম। জানালার বাইরে তাকিয়ে সিগারেট টানতে টানতে হঠাৎ চোখে পড়লো, সিগারেটে উপরে Benson & Hedges লেখাটা সম্পূর্ণ উল্টো!
ছোট্ট একটু ভুলে সিগারেটটাকে দেখতে হাস্যকর লাগছে। এটা কি ছাপানোর ভুল? সিগারেটের গায়েও প্রিন্টিং মিস্টেক হয়?
অপর সিগারেটগুলো ঠিক আছে কি না দেখার জন্য সিগারেটের প্যাকেটটা আবার হাতে নিতেই খেয়াল হলো, প্যাকেটের গায়ের লেখাগুলোও উল্টো। এমন কি “ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” লেখাটাও!
আমি এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে সারা ঘরে তাকালাম। ঘরের সব আসবাবপত্র আগে যেমনি ছিলো তার উল্টো করে সাজানো! দেয়ালে ঘড়ির গায়ের সংখ্যাগুলোও উল্টো লেখা! ডান থেকে বামপাশে এগিয়ে গেছে ১ থেকে ১২!
পাশে টেবিলের উপরে থাকা প্রত্যেকটা বইয়ের মলাটের লেখা উল্টে গেছে!
একটা বই হাতে নিয়ে ভেতরে উল্টে পাল্টে দেখলাম।
সবকিছু বিম্বায়ন হয়েছে কী করে?
ঘরের দেয়াল, জানালা, দরজা, ইলেক্ট্রিসিটির সুইচ বোর্ড, আলমারি, টেবিল, ঘড়ি -সবকিছু উল্টো!
হঠাৎ ফোন বাজতে শুরু করলো। আমি দ্রুত ফোন হাতে নিলাম। ফোনের ডিসপ্লে, পাওয়ার বাটন, ভল্যুউম কী -এসবও উল্টো।
... এবারে যে নম্বর থেকে কল এসেছে তা আমারই নম্বর, কিন্তু আমার নম্বর এবারে উল্টো দেখাচ্ছে না। বরং সোজা দেখাচ্ছে!