আজ খুব উত্তেজিত সায়নী। ওর কাছে খুব খুশীর দিন। যদিও ওর জীবনের সবচেয়ে বড় দিনটা আসতে আর মাত্র একমাস বাকী।
হ্যাঁ, আর মাত্র একমাস পরেই সায়নীর বিয়ে তাপসের সাথে। তাই আজকের দিনটাও ওর কাছে ভেরি ভেরি স্পেশাল।
বাড়ীতে মিথ্যে কথা বলে এসেছে আজ ও। কলেজের পুরোনো বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে, এই বলে বাবা মার কাছ থেকে পারমিশান পেয়েছে। আর এই সুযোগে ও এসেছে তাপসের সাথে কারশিয়াং। বিয়ের আগে ছোট্ট একটা হানিমুন, তাও আবার হবু বরের সাথে। লুকিয়ে প্রেম করার এই আস্বাদটা বিয়ের পরে আর পাবে না। তাই তাপস যখন এই প্রস্তাবটা দিলো তখন এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলো সায়নী।
তাপসকে পাগলের মতো ভালোবাসে সায়নী। অনেক কষ্ট করে আজ তাপসকে পেয়েছে ও। নয়তো একসময় ভেবেছিলো অরুনিমার কাছে এতেও হেরে যাবে।
অরুনিমা, এই নামটাকে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করে সায়নী। ওর জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। অথচ ওর নিজের মাসীর মেয়ে। হয়তো ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারতো। কিন্তু মাসী আর মেসোর আক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর কোথা থেকে যেন ওর জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসলো ওই মেয়েটা। এসেই সবকিছুতে সমান ভাগ বসালো। ওর রুমেই জায়গা নিলো, প্রাইভেসি বলে আর কিছু থাকেনি সায়নীর। মা বাবাও যেন ওর দিকেই ছিলো। ও কি খেতে ভালবাসে, কি করলে ওর মন ভালো থাকবে সেই সব্দিকে নজর ছিলো মায়ের। ধীরে ধীরে নিজের ঘরেই ব্রাত্য হয়ে উঠেছিলো।
অথচ সবদিক থেকেই ওর থেকে নিজেকে বেটার মনে করতো সায়নী। একটা আনস্মার্ট গাঁইয়া মেয়ে ছাড়া অরুনিমাকে আর কিছুই মনে করতো না ও। জীবনে জিন্স আর টপ পরে দেখেনি, কেবল ওই সালোয়ার আর চুড়িদার। আর কাজের মধ্যে ছিলো খালি বই মুখে গুঁজে বসে থাকা। সেইজন্য রেজাল্ট ভালো করতো মেয়েটা। আর ওই একটি কারণের জন্যই সবসময় মায়ের কথা- “ অরুকে দেখে কিছু শেখ সায়নী। সারাদিন টো টো করে না ঘুরে পড়াশোনায় যদি একটু মনোযোগ দিস।“
তা মা বাবার এই আদরের অরু যখন উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করলো তখন কলকাতায় ভালো কলেজে পড়তে পাঠালো। সায়নী ভেবেছিল এবারে মুক্তি পেলো কিন্তু অরু একা কি করে থাকবে সেই চিন্তা করে ওকেও কলকাতায় পড়তে পাঠানো হল। একই কলেজে ভর্তি হল দুজনে। একই মেসে একই রুমে থাকতে হল। তবে বাঁচোয়া ছিলো যে দুজনের সাবজেক্ট আলাদা। সেইজন্যই কলকাতায় পড়তে আসাটা অভিশাপ হয়ে যায়নি। আর এখানে না এলে জীবনে স্বাধীনতা যে কাকে বলে সেটা বুঝতেও পারতো না সায়নী।
কলেজে প্রথম থেকেই দুবছরের সিনিয়র তাপসকে ওর ভালো লাগতো। কিন্তু প্রথমে সাহস করে বলতে পারেনি। তারপরে যখন কয়েকজনের মুখে শুনলো তাপস নাকি অরুকে পছন্দ করে তখন মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো সায়নীর। একদিন খুব কড়া কড়া কথা শুনিয়েছিল অরুকে। সেদিন খুব কেঁদেছিল মেয়েটা। সায়নীরও খুব খারাপ লেগেছিল পরে। অমনভাবে না বললেই হতো। আসলে এইখানেও ওই আনস্মার্ট গাঁইয়াটার কাছে হেরে যাবে, এটা ভেবেই রেগে গিয়েছিলো। কিন্তু তার কিছুদিন পরে যে অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটল তারপরে ওই খারাপ লাগাটা ওর চলে গিয়েছিলো।
সারাজীবন ভালো মেয়ের মুখোশ পরে থাকা অরুনিমার আসল চেহারাটা সবার সামনে এসে যায়। একটা ভিডিও মেসেজ। আর সবাই জানতে পারে অরু আসলে কি জিনিস ছিলো। মাঝে মাঝে রাত করে মেসে ফিরতো অরু। তখন কিছু না ভাবলেও পরে সায়নী জেনেছিল বদসঙ্গ ধরেছিল মেয়েটা। কলেজের কিছু বড়লোকের ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা বেড়েছিল। তাদেরকে পটিয়েই নাকি চলতো ওর ফুর্তি। ক্রমশ আরও নানা রকমের নোংরা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলো। সেইরকমই কোন এক ফুর্তির রাতের ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। কলেজের প্রত্যেকের মোবাইলের মতো সায়নীর মোবাইলেও এসেছিলো সেটা। দেখার পর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি। সেইদিন রাতে মেসেও ফেরেনি মেয়েটা। পরেরদিন সকালে ফিরেছিল উস্কখুস্ক চুল নিয়ে। সেইদিনই ওকে মেস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। যাবার সময় খুব ন্যাকা কান্না কেঁদেছিল অরু। কিন্তু ওর কোন কথাই সেদিন শোনেনি সায়নী। অবশ্য ওর মত মেয়ের সাথে কথা বলার কোন রুচিও ছিল না।
মেস থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলো তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। মেয়েটা বাড়ী ফিরে যেতে পারে মনে করে মা বাবাকে সব জানিয়েছিল সায়নী। মা তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি। কিন্তু বাড়ীতে ফিরে যায়নি অরু। যাবেই বা কোনমুখে। পুলিশে জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি মেয়েটার। একদম উবে গিয়েছিলো। মনে হয় সেই অন্ধকার জগতেই পাকাপাকি ঠাই নিয়েছে।
তবে এই ঘটনা সায়নীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপরেই ও আর তাপস কাছাকাছি আসে। অরুর প্রতি একটু হলেও দুর্বল ছিল তাপস। আর সেটাকেই কাজে লাগিয়েছিল সায়নী। তাপসের ভেঙে পড়া মনকে সান্ত্বনা দিয়ে তাপসের মনে নিজের পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিলো ও। জিতে নিয়েছিলো তাপসকে। তারপর প্রেমপর্ব। যদিও অরু চলে যাবার পর মা কাছে এসে থাকতো তবুও মাঝে মাঝে কলেজ পালিয়ে, এদিক ওদিক করে সময় ঠিক বার করে ফেলতো সায়নী।
সেই ঘটনার পর দুবছর কেটে গেছে। অরুর ছায়া একপ্রকার মুছেই ফেলেছে নিজেদের জীবন থেকে।
“ধুর, আজ আবার এইসব ভাবছি কেন?”- আপনমনেই বলে উঠলো সায়নী।
নিজের এই স্পেশাল দিনটাতে কথাগুলো ভেবে সময় নষ্ট করার জন্য মনে মনে নিজেকে গাল দিলো ও। তাপস বাইরে গেছে ড্রিংক্স আনতে।
“ও ফিরে এলে জীবনে সবচেয়ে রোম্যান্টিক সেলিব্রেশন উপহার দেব ওকে।“- ভাবতে ভাবতে তাপসের দেওয়া ড্রেসটা খুলে দেখল সায়নী। খুব সুন্দর টকটকে লাল রংয়ের গাউন। চটপট বাথরুমে ঢুকে ড্রেসটা পরে নিলো সায়নী। তারপর বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো আয়নাটার সামনে।
“বাঃ। দারুন লাগছে। তাপস চমকে যাবে। ও আসুক তারপর---- কিন্তু আয়নায় ওটা কি?”
চমকে উঠে পেছনদিকে তাকাল সায়নী।
“কই? কিছুই তো নেই।“- নিজের মনে বলেই আবার আয়নার দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখল ওর পেছনে ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে কি যেন উঠছে। ধীরে ধীরে সেই কুণ্ডলী একটা মুখের আকার নিচ্ছে। ক্রমশ সেই মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই মুখ সায়নী কোনদিন ভুলবে না। জীবনে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করেছে ও এই মুখকে।
হ্যাঁ, সায়নী আয়নায় দেখছে নিজের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্নকে। যে মুখ ও দেখছে সেটা আর কারুর নয়, অরুনিমার। আতঙ্কে চোখ বুজে ফেললো সায়নী। কিন্তু চোখ খুলতেই সেই একই দৃশ্য। এবার আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অরুনিমার মুখ। আর সেই মুখ যেন ধীরে ধীরে পেছন থেকে ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
ভয়ে কাঠ হয়ে গেলো সায়নী, আবার বন্ধ করে ফেললো চোখ। চোখবন্ধ থাকা অবস্থাতেই শরীরে একটা অদ্ভুত শীতলতা অনুভব হল সায়নীর। ধীরে ধীরে শরীর যেন শিথিল হয়ে আসছে। নিজের শরীর থেকে যেন নিয়ন্ত্রন হারিয়ে যাচ্ছে। আসতে আসতে চোখ ,এলে তাকাল সায়নী। সামনের আয়নায় নিজের মুখ ঝাপসা মনে হল। কি হচ্ছে বুঝতে পারার আগেই মাথার ভেতর শুনতে পেলো এক কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠস্বরের মালিক ওর চেনা।
“কেমন আছিস সায়নী?”
“অরু, তুই? এসব কি হচ্ছে? আমি কিসব উল্টোপাল্টা ভাবছি?”
“ না রে, তুই একদম ঠিক আছিস। আর আমি তো তোর কাছেই এসেছি।“
“কিন্তু তুই এভাবে, মানে এইরকম আমার মাথার ভেতরে তুই কি করে?—মানে কি হচ্ছে এসব?”
“ঠিকই ধরেছিস তুই, আমি এখন তোর মধ্যে। মানে ঠিক আমি নই, আমার আত্মা বলতে পারিস। মৃত্যুর পর মানুষের কাছে যেটা থাকে।“
“উফফ!!! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”
“স্বপ্ন নয় রে। একদম বাস্তব। আমি ফিরে এসেছি।“
“হে ভগবান, এসব কি সত্যি? তুই কি জন্য এসেছিস অরু? যে পথে তুই গিয়েছিলি তোর এমন পরিনতি তো হতই। অন্যের সর্বনাশ করে কি আর সুখ কেনা যায় রে? বেঁচে থাকতে তো আমায় শান্তি দিসনি। মরার পরেও ছাড়বি না। আবার চলে এলি আমার জীবনটা মাটি করে দিতে।“
“কিছু ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে গেছে রে। আজ সেটা পূরণ করবো।“
“কি এমন ইচ্ছে আছে তোর যেটা আমাকে দিয়ে পূরণ করবি?”
এমনসময় দরজায় নক করার শব্দ হল।
“সায়নী। মনে হয় তাপস এসেছে। চল দরজাটা খুলে দিয়ে আসি।“
সায়নী বুঝতে পারছে ওর শরীর এখন সম্পূর্ণরূপে অরুনিমার নিয়ন্ত্রনে। ধীরে ধীরে ওর শরীরটাকে দরজার কাছে নিয়ে গেলো অরুনিমা আর খুলে দিলো দরজাটা। এই অপার্থিব শক্তির সাথে লড়াইয়ের ক্ষমতা ওর নেই। কিন্তু নিজের চেতনা এখনো আছে। কথা বলার শক্তি আছে। সুযোগ পেলেই সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তাপস ঘরে ঢুকল। হাতে ড্রিঙ্কসের বোতল।
“নাও, ডার্লিং। এগুলো রাখো। ওহ! তুমি তো দেখছি রেডি। দারুন লাগছে তোমায়। একটু দাঁড়াও আমি ফ্রেশ হয়ে নি।“
“হ্যাঁ। তুমিও তৈরি হয়ে নাও। কতরাত অপেক্ষা করে আছি আমি এই রাতটার জন্য।“
কথাটা শুনে থমকে গিয়ে পেছন ফিরে তাকালো তাপস। তারপর মুচকি হেসে বাথরুমে ঢুকে গেলো।
এতক্ষনে পুরো ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হল সায়নীর কাছে।
“ছি! ছি! কি নোংরা মেয়ে অরু। তাপসকে ভোগ করতে চায়। নিজের করে পেতে চায়। তাই নিজের বোনের শরীরে এসে ভর করেছে। মরার পরেও বাজে অভ্যাসটা ছাড়তে পারেনি। যারা ওকে আশ্রয় দিয়েছিলো নিজের লালসার জন্য তাদের ক্ষতি করতেও ও দুবার ভাবে না।“
“কি হল রে? কি ভাবছিস?”
“কি অকৃতজ্ঞ রে তুই অরু? এত নীচ তুই?
কোন জবাব এলো না অরুনিমার কাছ থেকে। সায়নীর মনে হচ্ছে এখুনি ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু ওর শরীর তো আর ওর কাছে নেই।
এইসময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তাপস। পরনে শুধু বারমুডা।
“পালিয়ে যাও তাপস!! পালিয়ে যাও এখান থেকে। আমার শরীরে অরুনিমার আত্মা ভর করেছে। মরার পরেও ও ফিরে এসেছে শুধু তোমাকে ভোগ করবে বলে। পালাও তুমি এখান থেকে। পালাও---“- প্রানপনে চিৎকার করে উঠলো সায়নী।
“চল ডার্লিং। একটু বাইরে ঘুরে আসি।“- জামাটা পরতে পরতে বলল তাপস।
“একি!!! তারমানে আমার আওয়াজ তাপসের কানে যায়নি। হে ভগবান এবার আমি কি করবো?”
“কেন তাপস ? বাইরে কেন যাবো? বাইরে গেলে কি সুবিধা হবে?”
“না মানে সারাদিন তো ঘরেই বসে থাকলে। তাই ভাবলাম একটু বেড়িয়ে আসি দুজনে।“
“ওহ, আমি ভাবলাম বাইরে তোমার বন্ধুরা ক্যামেরা নিয়ে রেডি আছে। ওদের জন্য বলছ বোধহয়।“
“ছেড়ে দে অরু। আমি মিনতি করছি। আমার এতবড় ক্ষতি তুই করিস না। ___ একি তাপস? তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? তারমানে ও কি বুঝতে পেরেছে এটা আমি নই?”
“এসব তুমি কি বলছ ডার্লিং। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।“
“কেন রজত, সন্তু, বিবেক এরা বাইরে নেই? ওই যে গেট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে কিছুদূর গিয়েই যে কালো স্করপিও গাড়িটা দাড়িয়ে আছে। আমি তো দেখতে পাচ্ছি ওরা ভেতরে বসে আছে।“
“একি বলছে অরু? রজত, সন্তু, বিবেক ওরা এখানে আসবে কেন? ও আর তাপস তো কাউকেই জানিয়ে আসেনি। এই অরু তুই এসব কি কথা বলছিস?”
“কি হল তাপস? জবাব দিচ্ছ না যে? ভাবছো আমি কি করে জানলাম। দেখো তো আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে, ভালো করে দেখো তো আমাকে চিনতে পারছো কিনা?”
ভালো করে সায়নীর মুখের দিকে তাকায় তাপস। মুখটা যেন কুয়াশায় ঢাকা। ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। ফুটে উঠছে একটা নতুন কিন্তু চেনা চেনা মুখ।
“একি অরুনিমা ? তুমিইইইইই-----“- ছিটকে সরে যায় তাপস। ওর চোখে আতঙ্কের চিহ্ন স্পষ্ট। “তুমি কি করে ? মানে--- আমি--- আ--আমরা তো তোমাকে---- না না এ হতে পারে না।“
“কি করেছিলে আমাকে? বল তাপস? বল কি হয়েছিলো আমার সাথে?”
“একি? তাপস কি করে জানবে অরুর সাথে কি হয়েছিলো? কি বলতে চাইছে অরু?”
“বল তাপস বল। আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হইনি বলে তুমি আর তোমার এই তিন বন্ধু মিলে কি করেছিলে আমার সাথে? ভুলে গেছো নাকি সবকিছু?”
“একি বলছিস তুই অরু?”
“হ্যাঁ সায়নী। আমার সর্বনাশের মূলে এই জানোয়ার। আমাকে বলেছিল ওর সাথে একরাত কাটাতে। অনেক টাকা দেবে। আমি রাজি হইনি রে। আমি বেশ্যা নই রে। হাতখরচটা যাতে নিজেই জোগাড় করে নিতে পারি সেইজন্য একটা টিউশানি ধরেছিলাম। সেইদিন বৃষ্টি পড়েছিলো বলে ফিরতে রাত হয়ে গেছিলো। এই জানোয়ারটা আর ওর তিন বন্ধু মিলে আমাকে তুলে নিয়ে যায় একটা পোড়ো বাড়ীতে। তারপর তিনজনে মিলে আমাকে রেপ করে। হ্যাঁ, ঠিক শুনছিস। রেপ করে আমায়। সাথে একটা ভিডিও করে যাতে শুধু আমার মুখটাই দেখা যায়। তারপর এরাই ওই ভিডিও ভাইরাল করে।“
“আমাকে ক্ষমা করে দাও অরুনিমা। আমার মস্ত ভুল হয়ে গেছে।“- হাতজোড় করে বলল তাপস।
“অপরাধ ক্ষমা করা যায় তাপস। পাপ নয়। আমার ভিডিও ভাইরাল করেই কি তোমরা থেমে গিয়েছিলে। সেদিন আমি যখন আমি মেস থেকে বেরিয়ে বাড়ী যাবো বলে স্টেশন যাচ্ছি তোমরা আবার কিডন্যাপ করো আমায়। তারপর নিয়ে আসো এইখানে। এই কারশিয়াং। এই হোটেলেই। এটা তো তোমার বন্ধু রজতের হোটেল, তাই না? তারপর এখানে আমাকে আবার শুধু রেপ করাই নয়, আমাকে মেরে ফেলে লাশটাও ফেলে দাও খাদে। আমাকে বেঁচে থাকতেও দিলে না তোমরা। তাই তো তোমাদের আসার জন্য অপেক্ষা করে আছি তারপর থেকে। আজ সেই অপেক্ষার অবসান। “
“ওহ অরু তুই আমাকে বলতে চেয়েছিলি। আমিই শুনিনি। আমি যদি সেদিন একবার তোর কথা শুনতাম তাহলে আজ তোকে হারাতাম না।“
“আমায় মেরো না অরুনিমা। আমি কথা দিচ্ছি নিজেকে বদলে নেবো। আমি তোমার বোনের জীবন থেকেও দূরে চলে যাবো।“
“আমার সাথে যা করেছো তার জন্য তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারলেও সায়নীর যে ক্ষতি আজ তুমি করতে চাইছিলে তার জন্য কি তোমাকে আমি ক্ষমা করতে পারি? ওকেও তুমি আজ এখানে নিয়ে এসেছিলে ওর হাল আমার মতন করবে বলেই তো? ওর জীবনটাও শেষ করে দিতে তুমি। আর তার জন্য তোমাকে ক্ষমা আর যেই করুক না কেন আমি অত্যন্ত পারবো না।“
এইসময় দরজাটা খুলে খালি গায়েই ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলো তাপস।
“আসি রে।“ সায়নীর মনে হল ওর শরীর যেন হাল্কা হয়ে গেলো। একটা হাওয়া ওর শরীর থেকে বেরিয়ে দরজা দিয়ে চলে গেলো।
কান্নায় ভেঙে পড়ল সায়নী। যাকে সারাজীবন ঘৃণা করে এলো সে মরার পরেও তার জীবন বাঁচিয়ে দিয়ে গেলো। ক্লান্তিতে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল সায়নী।
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে হোটেল ছেড়ে দিলো সায়নী। একটা গাড়ি ভাড়া করে চলল শিলিগুড়ির দিকে। রাস্তায় যেতে যেতে একজায়গায় ভিড় দেখে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। নেমে গিয়ে পাশের এক দোকানে কিসব কথা বলে আবার গাড়ি স্টার্ট করে ভিড় কাটিয়ে এগিয়ে চলল।
“কি হয়েছে সোনাম? অত ভিড় কেন ওখানে?” – ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো সায়নী।
“ ও কিছু না ম্যাডাম। এরকম হামেশাই হয়। চারটে বড়োলোকের বখাটে ছেলে। ড্রিঙ্ক করে চালাচ্ছিল। খাদে পড়েছে। চারজনেই ডেড। একজন তো এমন মাতাল শুধু একটা বারমুডা পরেছিল। কালো স্করপিও একেবারে দুমড়ে মুচড়ে গেছে।“
মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো সায়নী। আর কোন কথা ওর কানে ঢুকছিল না।
“সত্যি যাকে সারাজীবন হারাবার কথা ভেবেছিলাম তার জন্যই আজ জীবনে নতুনভাবে জিততে চাই। হ্যাঁ আজ থেকে নতুনভাবে বাঁচতে হবে। গিয়েই মা বাবাকে বলবো অরুর শ্রাদ্ধ শান্তি করতে। আর হ্যাঁ, কাউকে দেখানোর জন্য নয়, নিজের জন্যই চেষ্টা করবে অরুর মত হয়ে বাঁচবার।“
হটাত গাড়ির মধ্যে যেন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া কিছুক্ষণের জন্য ঢুকে আবার বেরিয়ে গেলো।
মাথার ভেতর শুনতে পেলো-“ আমাকে ভুলিস না কিন্তু।“
এই প্রথমবার অরুনিমার জন্য চোখদুটো জলে ভরে এলো সায়নীর।