১৫ বছরের দুটো মেয়ে অ্যালিসা এবং সারাহর গলাগলি বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই, যাকে বলে মানিকজোড়। একই এলাকায় থাকত ওরা, একই স্কুলের একই ক্লাসেই পড়ত। সহজ কথায় তাদেরকে আলাদা করা যেত না কখনো, কোনভাবেই। যদিও তাদের স্বভাব চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, অ্যালিসা ছিল উচ্ছল, প্রাণবন্ত ছুটাছুটি করে বেড়াত সারাক্ষণ আর সারাহ ছিল একেবারেই অ্যালিসার বিপরীত চরিত্র, ঠান্ডা, চুপচাপ, শান্ত লক্ষ্মী একটা মেয়ে।
একদিন দুই বন্ধু সারাহ আর অ্যালিসা একসাথে বসে গল্প করছিল, প্রসঙ্গক্রমে ওদের বন্ধুত্বের কথা উঠে আসলো।
“তোমার কি মনে হয় আমদের বন্ধুত্ব চিরদিন এইরকমই থাকবে? বেস্ট ফ্রেন্ড ফরেভার?” অ্যালিসা আলাপ শুরু করল।
“অবশ্যই থাকবে,” সারাহ উত্তর দিল, “কেনই বা থাকবে না?”
“জানি না,” চিন্তিত স্বরে বলল অ্যালিসা, “মানুষের বয়স যখন বাড়ে, সবাই ব্যস্ত হয়ে যায়, আস্তে আস্তে দূরে সরে যায়।”
“আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসছে,” উৎসাহী গলায় বলে উঠল সারাহ, “আসো আমরা রক্ত দিয়ে শপথ করি!”
“কি করবো?!”, হতভম্ব অ্যালিসা।
“রক্তের প্রতিজ্ঞা।,” সারাহ ব্যাখ্যা করল, “শোন, আমরা দুজনেই প্রতিজ্ঞা করবো যে আমরা চিরদিনই বন্ধু থাকবো, মানে ‘বিএফএফ – বেস্ট ফ্রেন্ডস ফরেভার’। যদি কোনদিন, কোন কারনে দুজন আলাদা হয়ে যাই বা আমাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমরা সম্ভব সব চেষ্টা করবো যেন আমরা আবার একসাথে হতে পারি।”
“পাগলের মত কথা বলছো সারাহ!”, অ্যালিসা বলল, “আমরা কোনদিন আলাদা হবো না, সবসময় একসাথেই থাকবো, তুমি দেখো।”
কিন্তু সারাহ কোনভাবেই বুঝতে চাইলো না, বার বার জোরাজুরি করতে লাগলো, অগত্যা কিছুটা মজা পেয়ে কিছুটা নতুন একটা খেলা মনে করে অ্যালিসা রাজী হয়ে গেল সারাহর কথাতে।
সারাহ দুইটা আলপিন খুঁজে বের করল। তারপর হোম ওয়ার্কের খাতা থেকে একটা সাদা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে কাগজের উপরের লাইনে লিখলো “বেস্ট ফ্রেন্ডস ফরেভার”, তার নিচে দুইজন পাশাপাশি নিজেদের নাম লিখলো। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তার আগুনে আলপিন দুইটার মাথা ঝলসে নিল। এবার আসল কাজ, দুই বন্ধু যার যার তর্জনীতে পিনের মাথা দিয়ে খোঁচা মেরে রক্ত বের করে নিজ নিজ নামের পাশে এক ফোঁটা করে রক্ত ফেলল। ব্যাস, তাদের রক্তের শপথ নেয়া শেষ, এখন থেকে ওরা
“বেস্ট ফ্রেন্ডস ফরেভার”।
সময় পার হয়ে যাচ্ছে, বছর ঘুরে বছর আসছে, মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, আর স্কুলের বাচ্চা না ওরা। অ্যালিসা বড় শহরের নামকরা কলেজে ভর্তি হয়েছে, সারাহ নিজদের শহরেই থেকে গেল, একটা দোকানে পার্টটাইম চাকুরীও শুরু করেছে। দুই বন্ধুই প্রেমে পড়ল, অবসরে বয়ফ্রেন্ডদের সময় দিতে হয় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু হাজার ব্যাস্ততার মধ্যেও দুই বন্ধুর ঠিক যোগাযোগ আছে, সপ্তাহে কম করেও এক/দুইদিন ফোনে কথা হয় দুই বেস্ট ফ্রেন্ডের মধ্যে।
অ্যালিসা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে খুব ভালো একটা চাকরী পেয়ে গেল। ও আর ওর বয়ফ্রেন্ড বিয়ে করবে ঠিক করল। কথামত বিয়ে করে, একটা বাড়ী কিনে সংসার শুরু করল নব দম্পতি। কয়েকবছর পরে তাদের কোল আলো করে একটা ফুটফুটে ছেলে হল। অ্যালিসা তার সংসার আর চাকুরী নিয়ে এতোটাই ব্যাস্ত হয়ে গেল যে সারাহকে ফোন করাটা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো ওর পক্ষে। এভাবে আস্তে আস্তে যোগাযোগ সম্পূর্ণই বন্ধ হয়ে গেল দুই বন্ধুর মধ্যে।
যদিও অ্যালিসা মাঝে মাঝে তার ছোটবেলার প্রাণপ্রিয় বন্ধুটার কথা প্রায়ই মনে করে, দুঃখ পায় কিন্তু আয়োজন করে খবর নেয়া আর হয়ে উঠে না। একটা সময় আসলো যখন জীবনের গতিপথ এই দুই মহিলাকে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা পথে চলতে বাধ্য করল, তারপর যা হয়, এই দুই বেস্ট ফ্রেন্ডের স্কুল জীবনের পর থেকে আর কখনো, কোনদিন দেখা হল না।
***
এক রাতে, অ্যালিসা ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন দেখলো। লম্বা অন্তহীন একটা হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে ও, বলা নেই কওয়া নেই, হটাত করে একটা ট্রাক লেন পরিবর্তন করে ওর লেনে চলে আসলো, ও ব্রেকের উপর প্রায় দাঁড়িয়ে গেল, ওদিকে ট্রাকটা যখনই ব্রেক করতে শুরু করলো সেই মুহূর্তে দুইটা গাড়ির চাকাই পিছলে গেল আর সাথে সাথেই একটা আরেকটার উপর গিয়ে আছড়ে পড়লো।
প্রচন্ড ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ওর, সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। নিজেকে ধাতস্ত করতে না করতেই শুনলো ওর বাড়ির সামনের দরজার বেলটা বাজছে ক্রমাগত। চট করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত তিনটার একটু বেশী। বিছানার অন্যধারে ওর হাজবেন্ড ঘুমিয়ে আছে, কিছু শুনেনি মনে হয়।
বেলটা আবার বেজে উঠল, সাথে সাথেই আবার। এতো রাতে কে আসলো তাও আবার সমানে বেল বাজাচ্ছে, আশ্চর্য! অ্যালিসা তাড়াতাড়ি উঠে নাইটগাউনটা পড়ে নীচে নেমে আসলো। দরজাটা খুলেই জমে গেল ও, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার সামনের লনে। মেয়েটার চেহারা ফ্যাকাশে, বিদ্ধস্তপ্রায় এবং কপাল ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে মুখের একটা পাশ সম্পূর্ণ ঢেকে গেছে, শরীরের কাপড়টাও রক্তে মাখামাখি। চেহারা অনেক পরিবর্তন হলেও ওকে সাথে সাথে চিনে ফেলল অ্যালিসা। ওর ছোটবেলার বন্ধু সারাহ।
“হায় আল্লাহ! সারাহ! কি হয়েছে তোমার?”, ফুঁপিয়ে উঠল অ্যালিসা।
সারাহ কিছু বলছে না, তাকিয়েই আছে ওর দিকে।
“বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছো তো, উঠে এসো।”, অ্যালিসা বলে চলেছে, “কিভাবে হল এসব?”
যেখানে আছে সেখানেই মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকলো সারাহ।
“কি হয়েছে তোমার? কথা বলছো না কেন?”, আর্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো অ্যালিসা।
“অনেকদিন তোমার দেখা নেই, অ্যালিসা!”, হিসহিসে গলায় কথা বলছে সারাহ, “আমার প্রতিজ্ঞা রাখতে এসেছি আমি, তোমাকে বলতে এসেছি, আমি বেঁচে নেই।”
অ্যালিসার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সারাহর দিকে। সারাহ হাত উঠিয়ে ওর তর্জনীর আঙ্গুল দিয়ে অ্যালিসের দিকে তাক করল, আঙ্গুল থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝরছে।
“জীবন আমাদের আলাদা করেছে,” সারাহ বলে চলেছে, “কিন্তু তোমার মৃত্যুর পর আবার আমরা এক সাথে হবো। আমি অপেক্ষা করছি.........”।
অ্যালিসা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।
পরেরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে নিজের ঘরে, নিজেরই বিছানায় আবিস্কার করল অ্যালিসা, পাশে ঘুমিয়ে আছে ওর হাজবেন্ড। হাত দিয়ে চোখ ডলে বুঝতে চেষ্টা করলো, সারারাত যা ঘটলো সেটা কি তাহলে শুধুই একটা বাজে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু না?
সকালের নাস্তার টেবিলে বসে টেলিভিশনটা খুলে খবর দেখে ওর শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেলো। সংবাদ পাঠক পড়ছে, “গতরাত আনুমানিক তিনটার দিকে মহাসড়কে একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। একটা তেলবাহী ট্রাক নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পাশের লেনের একটা প্রাইভেট কারের উপর আছড়ে পড়ে। প্রাইভেট কারের ড্রাইভার ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করে।”
“প্রাইভেট কারটি চালাচ্ছিলেন সারাহ নামের একজন ভদ্রমহিলা।”
সেই মুহূর্ত থেকে অ্যালিসার জীবন নরকতুল্য হয়ে উঠল। খাবার খায় না, বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে ভুলে যায়, অফিসে যায় না, যেদিন যায় কাজে মনযোগ দিতে পারে না।
প্রত্যেক রাতে সেই একই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নটা দেখতে থাকলো অ্যালিসা। দরজার বেল শুনে ঘুম ভেঙ্গে উঠে যায়, দরজা খুলেই দেখে বারান্দার সামনের লনে সারাহ দাঁড়িয়ে আছে, ওর তর্জনীর আঙ্গুল অ্যালিসার দিকে তাক করা, আঙ্গুল থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে আর সেই একই কথা বলছে, “আমি অপেক্ষা করছি.........”।
প্রত্যেক সকালে, অ্যালিসা ঘুম থেকে উঠে দেখে সমস্ত শরীর ঘামে ভিজা, বিছানা রক্তে ভেসে গেছে। তর্জনীর আঙ্গুল তীব্র যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে, আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দেখে রক্ত পড়ছে টপটপ করে।
ওর হাজবেন্ড বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এসব। সে অ্যালিসাকে নিয়ে বিভিন্ন ডাক্তার ঘুরে শেষ পর্যন্ত মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। সব ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষার পরও কোন ডাক্তারই ধরতে পারলেন না কি হয়েছে অ্যালিসার। এদিকে ওর অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠছে দিনকে দিন সাথে ওর দুঃস্বপ্ন, ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতর! কয়েকদিন সারাহকে নিজের শোবার ঘরে দেখতে পেল আর এখন প্রতিরাতে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অ্যালিসার দিকে ওর রক্তাক্ত তর্জনী তাক করে।
একরাতে, অমানুষিক এক চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেলো অ্যালিসার হাজবেন্ডের, লাফ দিয়ে উঠে অ্যালিসার দিকে তাকিয়ে দেখল বিছানা ফাঁকা, ও নেই বিছানায়। ঠিক তখনই গ্লাস ভাঙ্গার আওয়াজ আসলো বাথরুম থেকে, দৌড় দিয়ে বাথরুমে গিয়ে দেখলো বাথরুমের জানালার শার্সি ভাঙ্গা। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো নীচে টাইলস বিছানো রাস্তার উপর বাঁকাত্যাড়া হয়ে পড়ে আছে অ্যালিসা। প্রচণ্ড ভয়ে দৌড় দিয়ে নীচে নেমে আসল মানুষটা, অ্যালিসার কাছে গিয়ে দেখলো ওর স্ত্রীর মাথার চারিদিকে রক্তের পুকুর হয়ে আছে।
মৃতদেহের পাশে রাস্তার টাইলসের উপরে কে যেন ওর স্ত্রীর রক্ত দিয়ে লিখে রেখে গেছে “ফ্রেন্ডস ফরেভার”।
--------- শেষ -----------
“বেস্ট ফ্রেন্ডস ফরেভার”!