তীব্র গরম, খাঁ খাঁ মরুভূমির বুকে রক্তাক্ত অবস্থায় হেঁটে
চলেছেন নবীজী ﷺ,সাথে সঙ্গী যায়েদ বিন হারেসা (রা:), যার মাথায় ও আছে আঘাতের চিহ্ন।
এই আঘাত তীরের না,বল্লমেরও না, নবীজী ﷺ এর শরীর থেতলে দেওয়া এই আঘাতগুলো শত শত পাথরের। আঘাতগুলো এতোটাই গুরুতর যে কোথাও কোথাও শরীরের চামড়া ফেটে রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, কোথাও তা জমে গিয়েছে। পায়ের রক্ত তো জমাট বেঁধে পায়ের সাথে স্যান্ডেলকে আঠার মতো লাগিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু কী অপরাধে এই কষ্ট, এই রক্তক্ষরণ?
কেবলমাত্র একটাই অপরাধ আর তা হলো তায়েফের পথভ্রষ্ট মানুষগুলোর কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য দীর্ঘ ষাট মাইল পায়ে হেঁটে তায়েফ গমন। দীর্ঘ দশ দিন সময় নিয়ে নবীজী ﷺ সবর করে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে যান। কিন্তু এর বিনিময়ে নূন্যতম সম্মান পাওয়া তো দূরে থাক তাঁকে শুনতে হয়,"তুমি আমাদের শহর থেকে বের হয়ে যাও!"
এখানে শেষ করলেও কথা ছিলো, কিন্তু তায়েফের পথভ্রষ্ট হিংস্র নেতারা এখানেই শেষ করলো না বরং তায়েফবাসীদের লাগিয়ে দিলো নবীজী ﷺ এবং যায়েদ বিন হারেসা (রা:) এর পেছনে।এই লোকগুলো তাঁদের অনুসরণ করতে করতে তায়েফ শহরের বাইরে পাঁচ মাইল পথ পর্যন্ত হেঁটে আসলো পাথর নিক্ষেপ করতে করতে।অন্তর কতোখানি শক্ত আর পাষাণ হলে মানুষের পক্ষে এরূপ আচরণ করা সম্ভব তা যেন এই ঘটনায় স্পষ্ট প্রকাশ পায়।
আহত, অপদস্থ, রক্তাক্ত এবং ক্লান্ত নবীজী ﷺ এতো কঠিন সময়েও সবর ধরলেন,সাহায্যের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করলেন এবং ঐ এক আল্লাহর উপর ভরসা করে এরূপ ক্লান্ত শ্রান্ত শরীর নিয়ে ধু ধু মরুভূমির বুকে এগিয়ে চললেন।
পথিমধ্যে আশ্রয় নিলেন এক বাগানে।বাগানটা আবার যার তার বাগান না, ইসলামের শত্রু উতবা বিন রবীআ ও শায়বা বিন রবীআর বাগান।তারা নবীজী ﷺ এবং ইসলামকে অপছন্দ করলেও এরূপ সময়ে আল্লাহ পাক তাদের অন্তরে নবীজী ﷺ এর জন্য দরদ গেঁথে দিলেন।তারা তাদের দাস আদ্দাসকে দিয়ে নবীজী ﷺ এর নিকট কিছু ফল পাঠালো।
ইতিমধ্যে নবীজী ﷺ আল্লাহর নিকট দুআ করেছেন,
"আমি আপনার পবিত্র সত্তার ঐ নূরের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি,তা সর্বপ্রকার অন্ধকার দূর করে।আমি ঐ বস্তু থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা করছি ,যার কারণে আমার উপর আপনার ক্রোধ নিপতিত হবে। আপনার সন্তুষ্টিই আমার একান্ত তামান্না,যাতে করে আপনি আমার উপর রাজি খুশি হয়ে যান। আপনি ব্যাতীত কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই।"[১]
আর সাথে সাথেই আল্লাহ পাক রহমত স্বরূপ এক পাত্র আঙুর পাঠিয়ে দিলেন। নবীজী ﷺ পাত্র হাতে নিয়ে খাওয়ার পূর্বে বললেন,"বিসমিল্লাহ"।
অপরিচিত পথিকের মুখে এরূপ শব্দ শুনে দাস আদ্দাস তো রীতিমত অবাক হলো, এমনকি বলেই বসলো,"আল্লাহর কসম! এই শহরের কেউ তো এই কথা বলে খাওয়া শুরু করে না।"
নবীজী ﷺ আদ্দাসকে জিজ্ঞেস করলেন,
"তুমি কোথাকার বাসিন্দা এবং তোমার ধর্ম কি?"
উত্তরে আদ্দাস বললো,"আমি খ্রিষ্টান,নিনাওয়া আমার জন্মভূমি।"
নবীজী ﷺ আদ্দাসকে চমকে দিয়ে আরেকটা কথা বললেন,"তুমি ইউনুস ইবনে মাত্তার শহরের লোক!"
আদ্দাস আরো বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো নবীজী ﷺ কীভাবে নবী ইউনুস (আ:) কে চিনেন। নবীজী ﷺ বললেন,
"তিনি আমার ভাই,আমিও তার ভাই।তিনি একজন নবী ছিলেন,আমিও একজন নবী।"
আদ্দাস সাথে সাথে নবীজী ﷺ এর হাতে-পায়ে চুমু দিলো এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। নবীজী ﷺ সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতায় এতো সুন্দর ধারণা জন্মেছিলো আদ্দাসের মনে যে পরবর্তীতে মনিবদের জবাবদিহিতার মুখে সে বলল,"মনিব,এই ব্যাক্তির চেয়ে গোটা পৃথিবীতে উত্তম আর কিছু নেই।"
সুবহানাল্লাহ!
এটাই আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য।কেউ সরাসরি দাওয়াত পাওয়ার পরও ইসলামের আলো নিলোনা আবার কেউ নিজ পায়ে হেঁটে হেঁটে ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। আল্লাহ পাক তো বলেছেন,
"আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন তার নূরের দিকে।"[২]
দীর্ঘ দশদিন প্রচেষ্টায় যেখানে একটি মানুষ ও ইসলাম গ্রহণ করেনি সেখানে সামান্য একজন দাস কেবলমাত্র একটি শব্দ "বিসমিল্লাহ" শুনে ইসলাম গ্রহণ করে ফেললো।
'বিসমিল্লাহ' তথা 'আল্লাহর নামে শুরু করছি' কথাটি যে কতোটা তাৎপর্যপূর্ণ তা এই ঘটনায় দেখা যায়।
আমরা প্রায়ই আমাদের কাজেকর্মে বিশেষত খাওয়ার পূর্বে বিভিন্ন কথার ভিড়ে "বিসমিল্লাহ" বলতে ভুলে যাই। কিন্তু আদ্দাসের ঘটনাটির গভীরতা যদি অন্তর থেকে অনুভব করতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ আর কখনও হয়তো বিসমিল্লাহ বলতে ভুল হবে না।
আর যদি ভুলেও যান তবে খাওয়ার মধ্যে পড়ে নিতে পারেন,
بِسْمِ اللّٰهِ فِيْ أَوَّلِهِ وَآخِرِهِ
বিস্মিল্লাহি ফী আওওয়ালিহী ওয়া আখিরিহী
অর্থাৎ,এর শুরু ও শেষ আল্লাহ্র নামে।
মাশাল্লাহ