অনবরত মোবাইলটা বেজেই চলেছে। ঘুম ভাঙলেও ওঠে যেয়ে ফোনটা ধরবার ইচ্ছে হচ্ছে না। বিছানার পাশেই থাকার কথা কিন্তু চার্জ করতেই বোধ হয় অহনা
ওখানে নিয়ে রেখেছে। ড্রেসিং টেবিলটার পাশে ছোট্ট একটা সাইড বক্স ওটার ওপরেই রেখে চার্জ দিতে হয়।
থ্রি পিনের একটাই সকেট ওখানে আছে।
অহনা আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। আজ দেড় যুগ হয় আমরা সংসার করছি। আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল।আমার মা তখন বেঁচে ছিলেন। ঘরে আমার ছোট বোন তমা তখনও তার বিয়ে হয়নি।
আমাদের বাবা মারা গিয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে।
পরিবারের মুরুব্বি হিসেবে আমার বড় মামা ছিলেন।
অহনাদের পরিবারে দুই ভাই ও তার মা সাথে ভাবিদ্বয় আর ছোট ভাইপো দুটো।
একজন আত্মীয়া ঘটকালির কাজটা করেছিলেন।মায়ের এক কথা মেয়েটা যেন খুব ভালো আর সাংসারিক হয়।আমার বিয়ের পর তিনি তমার বিয়ে দেবেন।মায়ের যুক্তি ছিল ঘরে একটা বৌ থাকলে মেয়ে চলে গেলেও সেই শূন্য জায়গাটা তার বৌমা পুরণ করবে।
মায়ের মেয়ের বদলে একটা মেয়ে চাই।
আমি হাসি, তমাও হাসে।মায়ের এমন আহ্লাদী স্বপ্নটা পুরণ হোক আমি মন থেকে প্রার্থনা করি তখন।
অবশেষে অহনার খোঁজটা পাওয়া গেল।আমি ব্যবসার কাজটা গুটিয়ে বাসায় ফিরি।মা আমি তমা আর মামা সাথে সেই ঘটক আত্মীয়া সবাই মিলে যাই অহনাদের বাড়ি।অহনার মা আর আমার মা দু'জন মিলে অল্প সময়ের মধ্যেই জমিয়ে গল্প শুরু করেন।অহনাকে বের করা হলে প্রথম দেখাতেই তাকে ভালো লেগে যায় আমার।
কি মিষ্টি আর পবিত্র একটা মুখ। হালকা শ্যামলা গোছের এই মেয়ের জন্য মনে একটা লহরি বাজতে শুরু করে। তমা আমার মনের কথাটা পড়ে নেয়।
তাই সে সুযোগ করিয়ে দেয় ভাবিদের বলে কয়ে।
আমি অহনার সাথে কথা বলি।
এ কথা সেকথার পরই বুঝতে পারি আমাদের পছন্দ অপছন্দ গুলোর খুব মিল।আমি তাঁকে বলেই দেই
তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এতোটা যে তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে আজই নিয়ে চলে যাব।
ও চোখ তুলে আমার দিকে তাকায়।
এক মূহুর্তেই ওর চোখ আমাকে জানায় চলো আমি যাব।
আমাদের প্রথম দেখাটাই আমাদের প্রেমের সুচনা।
তারপর সামাজিক ও পারিবারিক কিছু রীতি অনুযায়ী আমাদের বিয়েটা হয়ে যায় দু 'সপ্তাহের মধ্যে।
অহনা আমার ঘর আমার হৃদয় আলোকিত করে হাতে তুলে নেয় আমার ও পরিবারের দায়িত্ব। মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন। বৌমার হাতে সংসার তুলে দিয়ে আত্মনিয়োগ করেন আধ্যাত্মিক জীবনে। অল্প দিনেই অহনা তার চমৎকার শৈল্পিকতা আর মাধুর্য দিয়ে ঘরকে একটি ফুলের বাগানে পরিণত করে।
তমা আর অহনা মিলে কি সুন্দর করে গল্প করে। মাঝে মধ্যে মা-ও শামিল হন গল্পে।আমি দূর থেকে দেখি চোখ জুড়িয়ে যায়। মনটা ভরে উঠে। একসময় তমার জন্য আলাপ আসতে শুরু করে এবং যথারীতি একটা ভালো সমন্ধ দেখে বিয়ে হয়ে যায়। ওর স্বামী আবির অস্ট্রেলিয়ায় থাকে তাই বিয়ের অল্প দিন পর সে-ও চলে যায়। যাবার সময় খুব কান্নাকাটি করে।অহনাকে ধরে ওর কান্না দেখে মনে হয় যেন ওর কতোকালের আপন কেউ।
মা অহনার বুকে মুখ গুঁজে সান্ত্বনা পান।
।
আমি অহনা আর মা এই তিনের সংসার তখন। ব্যবসার কাজ শেষ করে রাতে ফিরে দেখি মা ঘুমে।অথচ একসময় মা জেগে থাকতেন।আমি না এলে খেতেন না।এখন পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়ে পড়েন।অহনা তার যোগ্যতার সবটুকু দিয়ে ঘরটা আলোকিত করে রাখে।
এরই মধ্যে একদিন খবর আসে অহনার মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ী খুব অসুস্থ। মা নিজে সাথে করে নিয়ে যান অহনাকে তারপর দু তিন দিন অবস্থান করেন।
এ কদিন আমাকেও যাওয়া আসা করতে হয়।
এক সকালে শাশুড়ী মারা যান।
অহনাকে নিজের বুকে টেনে পরম মমতায় মাতৃ স্নেহে আগলে নেন আমার মা।আর তাই মায়ের শোক কাটিয়ে উঠতে খুব বেশি কষ্ট হয় না অহনার।
এভাবেই চলে যায় তিন চার বছর।। একসময় আমরা টের পাই আমাদের ঘর আলো করে আসছে কেউ একজন। মা অহনা আমি আর অষ্ট্রেলিয়া থেকে বোন, সবার আনন্দ আর ধরে না।দিন গণনা করা আর নানারকমের প্রস্তুতি চলতে থাকে ঘর জুড়ে।
অহনাকে মা নিজেই খুব খেয়াল রাখেন,যত্ন নেন।
প্রায় সাত মাস হতে চললো এমন সময় একদিন এক দূর্ঘটনা ঘটে যায়। অহনা বাথরুমে স্লিপ করে পড়ে যায়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়।ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানান সন্তানটি আর বেঁচে নেই। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মা এগিয়ে এসে জানান অপারেশন লাগলে করুন।আমার মেয়েটা যেন সুস্থ থাকে। অহনা মা'কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। একসময় একটা ফুটফুটে মেয়ে শিশুর ছোট্ট দেহ তুলে দেয়া হয় আমাদের কাছে।
এর সাথে ডাক্তাররা জানান আরও একটি দুঃসংবাদ।
অহনা আর কখনো মা হতে পারবে না।
এ সংবাদ শুনে আমি অহনার কাছে ছুটে যাই।ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি তুমি মোটেও চিন্তা করো না।আমরা আরও উন্নত চিকিৎসার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
তুমি মনকে শক্ত রেখো।
মেয়েকে দাফন করে ভগ্ন মনে ঘরে ফিরে আসি।
সপ্তাহ দিন মা'ই অহনার কাছে থাকেন।আমি প্রতিদিন যাওয়া আসা করি।তারপর অহনা ঘরে ফিরে আসে।
ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। মা আর অহনা এখনোও গল্পে গল্পে সময় কাটান।এভাবে কেটে যায় আরও তিন চার বছর।
একসময় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন।ধীরে ধীরে মায়ের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। মায়ের খুব যত্নআত্তি করে অহনা।মায়ের পাশেই শুয়ে থাকে অনেক রাত।
এক সকালে মা আমায় ডেকে পাঠান।সামনে বসতে বলেন।তারপর অহনাকে বলেন একটু বাইরে যেতে।
অহনা চলে গেলে মা বলেন -
আসিফ আমি হয়তো আর বাঁচব না বাবা।আমি মায়ের হাত ধরে বসে থাকি।তুই বৌমার কোনো অযত্ন বা অবহেলা করিস না।মা বাবা হারানো মেয়েটার জন্য আমার মনটা খুব কষ্ট পায়।তোর যদি আর সন্তান সন্ততি না-ও হয় তবু তুই বৌমাকে কখনো কোনো কষ্ট কিম্বা তার এই অসামর্থ্যতা নিয়ে কথা বলিস না।
তুই আমাকে কথা দে বাবা।আমি মায়ের হাতে মুখ গুঁজে বললাম মা তুমি এভাবে বলো না। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। আর তোমার বৌমাকে আমি কখনো কোনদিনও
কষ্ট দেবো না। আমি সন্তান ছাড়া একজীবন কাটাবো
অহনার কোনো কষ্ট হবে না ইনশাআল্লাহ।
তারপর মায়ের বুকে মাথা লুকিয়ে আমি খুব কাঁদলাম।
মা আমার মাথায় শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন।
সেই রাতেই মা পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন।
।
তমা ফোন করে খুব কাঁদলো। ওর শরীর ভালো ছিল না। সন্তানসম্ভবা থাকায় সে আসতে পারলো না।
মা'কে কবরে শুইয়ে রেখে ফিরে এলাম ঘরে যে ঘরে কেবল অহনা আর আমি।
এভাবেই কেটে গেল সতেরো বছর তার সাথে। গত বছর আমার আর অহনার শারীরিক পরীক্ষা করতে যেয়ে আমার রক্তে কিছু জটিলতা পাওয়া গেল।
তারপর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা গেল আমার রক্তে ক্যান্সার।এবং তা খুব শেষের দিকে। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করানো হলো।কিন্তু ক্রমাগত আমার শরীর খারাপ হতে থাকলো।আমার চিকিৎসার ব্যয়ের জন্য ব্যবসার পুঁজি সঙ্কট দেখা দিল।একসময় অহনা তার পরিবারের কাছে সাহায্য চেয়ে বিমুখ হয়ে ফিরে এলো।ভাইয়েরা নানা অজুহাত দেখিয়ে পিছপা হয়ে গেল।
অষ্ট্রেলিয়া থেকে বোন তার সাধ্যমতো কিছু সাহায্য পাঠালো কিন্তু সেসবই বিফল আর অপর্যাপ্ত হয়ে দাঁড়ালো। আমি অহনাকে বললাম আর চিকিৎসার জন্য খরচ না করতে। আমি কিছুতেই চাইছিলাম না আমার মৃত্যুর পর অহনা দেনায় থাকুক।
কিন্তু যা আমাকে কুরকুরে খাচ্ছিলো তা হলো আমার মৃত্যুর পর অহনার নিঃসঙ্গ জীবন।। ও একা একা কিভাবে জীবন কাটাবে?
অবশেষে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। বিশেষ একটা চিঠি লিখে পাঠালাম এক জায়গায়।আমার শরীর খুব খারাপ করলে আমাকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলো।
অহনাকে অনুরোধ করলাম আমার মৃত্যুর পর সে যেন এই ঠিকানায় চলে যায়। সে জানতে চাইলো কেন এভাবে বলছি। আমি বললাম আমার মৃত্যুর পর তুমি একা নিঃসঙ্গ থাকো আমি তা চাই না।
অহনা খুব কাঁদতে লাগলো।এমন সময় দরজায় এক সৌম্য দর্শন মধ্য বয়সী ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন।
ইশারায় উনাকে কাছে ডাকলাম। অহনা মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল।অহনার কলেজ জীবনের বন্ধু ফিরোজ।যিনি পারিবারিক চাপে বিয়ে করে ইংল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন।যার স্ত্রী গত হয়েছেন চার বছর আগে। অহনার ডায়েরি থেকে পাওয়া তার বাড়ির ঠিকানা থেকে সব তথ্য পাই। তারপর চিঠি লিখে বিস্তারিত জানিয়ে একটা অনুরোধ পাঠাই।
ফিরোজ তুমি?
ভদ্রলোক আমার কাছাকাছি আসতে আসতে বললেন
--আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি অহনার দায়িত্ব নিলাম।
ঠিক তখনই অহনা উঠে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো --
এই তুমি আমাকে চিনলে না আজও।আমি তোমার জায়গায় তোমার আসেন আর কাউকে কখনো আনবো না।তুমি কিছুতেই এমন কোনো ভাবনা মনে এনো না।
আমি একটা চাইল্ড হোম প্ন্যান করে রেখেছি। ইতিমধ্যে কিছু অনাথ শিশুদের তথ্য জোগাড় করেছি ওরা আসছে। একটা বিধবা ও অনাথ ছেলে ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে।
তুমি কষ্ট পাবে তোমাকে জীবদ্দশায় রেখে আমি এমনটা করছি তাই বলিনি তোমায় কিন্তু এখন আর বা বলে পারলাম না।
আমি অহনার কোলে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস গুনছি আর অহনার দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাপানি।
ফিরোজ সাহেব মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন....