একটা গাভী আর কয়েকটা খাসি তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওগুলো মাঠে চরাত। বিকেল বেলা গাভীর দুধ নিয়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করত। দুধ বিক্রির আয় থেকে সঞ্চিত আট টাকা দিয়ে তিনি পান-বিড়ির দোকান দেই।
তার জন্ম জামালপুর জেলার এক অজপাড়াগাঁয়ে। ১৪ কিলোমিটার দূরের শহরে যেতে হতো পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে চড়ে। পুরো গ্রামের মধ্যে একমাত্র মেট্রিক পাস ছিলেন তার চাচা মফিজউদ্দিন। তার বাবা একজন অতি দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক। তারা ছিল পাঁচ ভাই, তিন বোন। কোনরকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতো তাদের।
দাদার আর্থিক অবস্থা ছিলো মোটামুটি। কিন্তু তিনি তার বাবাকে তাঁর বাড়িতে ঠাঁই দেননি। দাদার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটা ছনের ঘরে তারা এতগুলো ভাই-বোন আর বাবা-মা থাকতাম। মা তাঁর বাবার বাড়ি থেকে নানার সম্পত্তির সামান্য অংশ পেয়েছিলেন। তাতে তিন বিঘা জমি কেনা হয়। চাষাবাদের জন্য অনুপযুক্ত ওই জমিতে বহু কষ্টে বাবা যা ফলাতেন, তাতে বছরে ৫/৬ মাসের খাবার জুটতো। দারিদ্র্য কী জিনিস, তা তিমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন- খাবার নেই, পরনের কাপড় নেই; কী এক অবস্থা !
তার মা সামান্য লেখাপড়া জানতেন। তাঁর মায়ের কাছেই তার পড়াশোনার হাতেখড়ি। তারপর বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু তার পরিবারে এতটাই অভাব যে, তিনি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে উঠল, তখন আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলো না। বড় ভাই আরো আগে স্কুল ছেড়ে কাজে ঢুকেছেন। তাকেও লেখাপড়া ছেড়ে রোজগারের পথে নামতে হলো।
তাদের একটা গাভী আর কয়েকটা খাসি ছিল। তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওগুলো মাঠে চরাত। বিকেল বেলা গাভীর দুধ নিয়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করত। এভাবে দুই ভাই মিলে যা আয় করতো, তাতে কোনরকমে দিন কাটছিল। কিছুদিন চলার পর দুধ বিক্রির আয় থেকে সঞ্চিত আট টাকা দিয়ে তিনি পান-বিড়ির দোকান দেয়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে বসত। পড়াশোনা তো বন্ধই, আদৌ করবে- সেই স্বপ্নও ছিল না !
এক বিকেলে বড় ভাই বললেন, আজ স্কুল মাঠে নাটক হবে। স্পষ্ট মনে আছে তার, তখন তার গায়ে দেওয়ার মতো কোন জামা নেই। খালি গা আর লুঙ্গি পরে তিনি ভাইয়ের সঙ্গে নাটক দেখতে চলেছিলেন। স্কুলে পৌঁছে তিনি তো বিস্ময়ে হতবাক ! চারদিকে এত আনন্দময় চমৎকার পরিবেশ ! তার মনে হলো, তিনিও তো আর সবার মতোই হতে পারতো। সিদ্ধান্ত নিলো, তাকে আবার স্কুলে ফিরে আসতে হবে।
নাটক দেখে বাড়ি ফেরার পথে বড় ভাইকে বলল, আমি কি আবার স্কুলে ফিরে আসতে পারি না ? তার বলার ভঙ্গি বা করুণ চাহনি দেখেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক কথাটা ভাইয়ের মনে ধরলো। তিনি বললেন, ঠিক আছে কাল হেডস্যারের সঙ্গে আলাপ করবো।
পরদিন দুই ভাই আবার স্কুলে গেল। বড় ভাই তাকে হেডস্যারের রুমের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে গেলেন। তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনেছিল, ভাই বলছেন তাকে যেন বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগটুকু দেওয়া হয়। কিন্তু হেডস্যার অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বললেন, সবাইকে দিয়ে কি লেখাপড়া হয় ! স্যারের কথা শুনে তার মাথা নিচু হয়ে গেল। যতখানি আশা নিয়ে স্কুলে গিয়েছিল, স্যারের এক কথাতেই সব ধুলিস্মাৎ হয়ে গেল। তবু বড় ভাই অনেক পীড়াপীড়ি করে তার পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি যোগাড় করলেন। পরীক্ষার তখন আর মাত্র তিন মাস বাকি। বাড়ি ফিরে মাকে বলল, তাকে তিন মাসের ছুটি দিতে হবে। তিনি আর এখানে থাকবে না। কারণ ঘরে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই- তার কোন বইও নেই, কিন্তু তাকে পরীক্ষায় পাস করতে হবে।
মা বললেন, কোথায় যাবে ? বলল, আমার এককালের সহপাঠী এবং এখন ক্লাসের ফার্স্টবয় মোজাম্মেলের বাড়িতে যাবো। ওর মায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। যে ক’দিন কথা বলেছি, তাতে করে খুব ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমাকে উনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।
দুরু দুরু মনে মোজাম্মেলের বাড়ি গেল সে। সবকিছু খুলে বলতেই খালাম্মা সানন্দে রাজি হলেন। তার খাবার আর আশ্রয় জুটলো; শুরু হলো নতুন জীবন। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করল। প্রতিক্ষণেই হেডস্যারের সেই অবজ্ঞাসূচক কথা মনে পড়ে যায়, জেদ কাজ করে মনে; আরো ভালো করে পড়াশোনা করে সে।
যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু হলো। তিনি এক-একটি পরীক্ষা শেষ করছেন আর ক্রমেই যেন উজ্জীবিত হচ্ছেন। তার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যাচ্ছে। ফল প্রকাশের দিন তিঞ্জ স্কুলে গিয়ে প্রথম সারিতে বসলেন। হেডস্যার ফলাফল নিয়ে এলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, পড়তে গিয়ে তিনি কেমন যেন দ্বিধান্বিত। আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছেন। তারপর ফল ঘোষণা করলেন। তিনি প্রথম হয়েছেন ! খবর শুনে বড় ভাই আনন্দে কেঁদে ফেললেন। শুধু তিনি নির্বিকার- যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল।
বাড়ি ফেরার পথে সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সে আর তার ভাই গর্বিত ভঙ্গিতে হেঁটে আসছি। আর পিছনে এক দল ছেলেমেয়ে তাকে নিয়ে হৈ চৈ করছে, স্লোগান দিচ্ছে। সারা গাঁয়ে সাড়া পড়ে
নিয়ে এসে তাকে দেখালেন। ওইটা ছিল ক্যাডেট কলেজে ভর্তির বিজ্ঞাপন। যথাসময়ে ফরম পুরণ করে পাঠালেন। এখানে বলা দরকার, তার নাম ছিল আতাউর রহমান। কিন্তু ক্যাডেট কলেজের ভর্তি ফরমে স্কুলের হেডস্যার তার নাম আতিউর রহমান লিখে চাচাকে বলেছিলেন, এই ছেলে একদিন অনেক বড় কিছু হবে। দেশে অনেক আতাউর আছে। ওর নামটা একটু আলাদা হওয়া দরকার; তাই আতিউর করে দিলাম।
তিনি রাত জেগে পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিলেন। নির্ধারিত দিনে চাচার সঙ্গে পরীক্ষা দিতে রওনা হলো সে। ওই তার জীবনে প্রথম ময়মনসিংহ যাওয়া। গিয়ে সবকিছু দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ ! এত এত ছেলের মধ্যে তিনিই কেবল পায়জামা আর স্পঞ্জ পরে এসেছিল ! তার মনে হলো, না আসাটাই ভালো ছিল। অহেতুক কষ্ট করলেন। যাই হোক পরীক্ষা দিলেন; ভাবলেন হবে না। কিন্তু দুই মাস পর চিঠি পেল, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। এখন চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যেতে হবে।
সবাই খুব খুশি; কেবল তিনিই হতাশ। তার একটা প্যান্ট নেই, যেটা পরে যাবে সে। শেষে স্কুলের কেরানি কানাই লাল বিশ্বাসের ফুলপ্যান্টটা ধার করলেন। আর একটা শার্ট যোগাড় হলো। তিনি আর চাচা অচেনা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন। চাচা শিখিয়ে দিলেন, মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে তিনি যেন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলে: ম্যা আই কাম ইন স্যার ? ঠিকমতোই বললেন। তবে এত উচ্চস্বরে বললেন যে, উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
পরীক্ষকদের একজন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ এম. ডাব্লিউ. পিট তাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে সবকিছু আঁচ করে ফেললেন। পরম স্নেহে তিনি তাকে বসালেন। মুহূর্তের মধ্যে তিনি তার খুব আপন হয়ে গেলেন। তার মনে হলো, তিনি থাকলে তার কোন ভয় নেই। পিট স্যার তার লিখিত পরীক্ষার খাতায় চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর অন্য পরীক্ষকদের সঙ্গে ইংরেজিতে কী-সব আলাপ করলেন। তিনি সবটা না বুঝলেও আঁচ করতে পারলাম যে, তাকে তাঁদের পছন্দ হয়েছে। তবে তাঁরা কিছুই বললেন না। পরদিন ঢাকা শহর ঘুরে দেখে বাড়ি ফিরে এলেন। যথারীতি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলো সে। কারণ সে ধরেই নিয়েছিল যে, তার চান্স হবে না।
হঠাৎ তিন মাস পর চিঠি এলো। তিঞ্জ চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। মাসে ১৫০ টাকা বেতন লাগবে। এর মধ্যে ১০০ টাকা বৃত্তি দেওয়া হবে, বাকি ৫০ টাকা তার পরিবারকে যোগান দিতে হবে। চিঠি পড়ে মন ভেঙে গেল। যেখানে তার পরিবারের তিনবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, এবং সে চাচার বাড়িতে মানুষ হচ্ছে, সেখানে প্রতিমাসে ৫০ টাকা বেতন যোগানোর কথা চিন্তাও করা যায় না !
এই যখন অবস্থা, তখন প্রথমবারের মতো তার দাদা সরব হলেন। এত বছর পর নাতির (তার) খোঁজ নিলেন। তাকে অন্য চাচাদের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমরা থাকতে নাতি আমার এত ভালো সুযোগ পেয়েও পড়তে পারবে না ? কিন্তু তাঁদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল না। তাঁরা বললেন, একবার না হয় ৫০ টাকা যোগাড় করে দেবো, কিন্তু প্রতি মাসে তো সম্ভব নয়। দাদাও বিষয়টা বুঝলেন।
তিনি আর কোন আশার আলো দেখতে না পেয়ে সেই ফয়েজ মৌলভী স্যারের কাছে গেলেন। তিনি বললেন, আমি থাকতে কোন চিন্তা করবে না। পরদিন আরো দুইজন সহকর্মী আর তাকে নিয়ে তিনি হাটে গেলেন। সেখানে গামছা পেতে দোকানে দোকানে ঘুরলেন। সবাইকে বিস্তারিত বলে সাহায্য চাইলেন। সবাই সাধ্য মতো আট আনা, চার আনা, এক টাকা, দুই টাকা দিলেন। সব মিলিয়ে ১৫০ টাকা হলো। আর চাচারা দিলেন ৫০ টাকা। এই সামান্য টাকা সম্বল করে তিনি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলেন। যাতায়াত খরচ বাদ দিয়ে তিনি ১৫০ টাকায় তিন মাসের বেতন পরিশোধ করলেন। শুরু হলো অন্য এক জীবন।
প্রথম দিনেই এম. ডাব্লিউ. পিট স্যার তাকে দেখতে এলেন। তিনি সবকিছু খুলে বললেন। আরো জানালেন যে, যেহেতু তার আর বেতন দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাই তিন মাস পর ক্যাডেট কলেজ ছেড়ে চলে যেতে হবে। সব শুনে স্যার তার বিষয়টা বোর্ড মিটিঙে তুললেন এবং পুরো ১৫০ টাকাই বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এস.এস.সি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে পঞ্চম স্থান অধিকার করলেন এবং আরো অনেক সাফল্যের মুকুট যোগ হলো।
তার জীবনটা সাধারণ মানুষের অনুদানে ভরপুর। পরবর্তীকালে তিনি তার এলাকায় স্কুল করেছিলেন, কলেজ করেছিলেন। যখন যাকে যতটা পারতেন, সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতাও করতেন। কিন্তু সেই যে হাট থেকে তোলা ১৫০ টাকা; সেই ঋণ আজও শোধ হয়নি। তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করলেও সেই ঋণ শোধ হবে না!
(অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের নিজের ভাষায় তাঁর জীবন কথা আমি আমার মতো করে বলার চেষ্টা করলাম )
Onk valo likhcen.. Also like my article