এইচএসসি পরীক্ষার মাসছয়েক আগে অজপাড়া গায়ের অখ্যাত কলেজের একজন শিক্ষক শহরের বিখ্যাত কলেজে গিয়ে চ্যালেঞ্জ করে আসলেন, "আপনাদের অমুক ছাত্র নাকি এবার বোর্ডে ফার্স্ট হওয়ার জন্য টার্গেট নিয়েছে? তাহলে তাকে বলে দিয়েন, যদি ফার্স্ট হওয়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলে যেন এই বছর এইচএসসি পরীক্ষা না দেয়। কারণ, এই বছর আমার কলেজের গৌরাঙ্গই বোর্ডে ফার্স্ট হবে।"
অথচ এই গৌরাঙ্গ ঢাকার নামকরা এক কলেজ থেকে পরপর দুই বছর সাইন্স বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করেন। তৃতীয়বার গ্রামের এই কলেজে এসে কমার্স নিয়ে ভর্তি হন। এমন একজন ছাত্রকে নিয়ে গৌরব করে বোর্ডে ফার্স্ট হওয়ার চ্যালেঞ্জ করা সত্যিই স্পর্ধার ব্যাপার। আর কেন সেই শিক্ষক এমন স্পর্ধা দেখালেন, সেই গল্পই আজ আমি বলব।
গৌরাঙ্গ দেবনাথের জন্ম একটি বিত্তবান পরিবারে। তার বাবার বড় লুঙ্গির ব্যবসা ছিল, যেখানে ৩০ জন কর্মচারী কাজ করতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, প্রাইমারির গণ্ডি পেরুনোর আগেই তার বাবা মারা যান। ইন্টারে পড়ুয়া তার বড় ভাই শত চেষ্টা করেও বাবার ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না, শুরু হলো তাদের দুঃখ দুর্দশার দিন।
বাড়ির অভাব-অনটন দিনকেদিন বাড়তে থাকায় হাইস্কুলে ওঠার পর তার মা তাকে কক্সবাজারে মামার বাসায় পাঠানোর চিন্তা করেন। কিন্তু অন্য শহরে পরে যাওয়ার মতো একটা প্যান্টও ছিল না তার। এক বন্ধুর কাছে ১০ টাকা দিয়ে পুরোনো একটা প্যান্ট কিনে রওনা হলো মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে । ভাগ্য সেখানেও তার সহায় হলো না। ১৯৯১ সালের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর ফিরে আসেন।
এরপর নিজ এলাকার এক হাইস্কুলে এসে ভর্তি হন। গণিতে তিনি এতটাই ভালো ছিলেন যে, গণিত স্যার তাকে দিয়ে বোর্ডে অংক করাতেন। এসসসিতে তার স্কুলের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৯৮ নম্বর পেয়ে তিনি ৫ স্টার গ্রেডে উত্তীর্ণ হন। ইচ্ছা ছিল, ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার৷ কিন্তু সে বছর ঢাকা কলেজে আবেদন করার জন্য ন্যূনতম ৮০০ নম্বরের প্রয়োজন ছিল। মাত্র 'দু' নম্বরের ব্যবধান বলে তিনি ভর্তি হতে পারেন। তিনি কলেজে গিয়ে অনুনয়-বিনয়ও করেছিলেন, কিন্তু কোন লাভ হয়নি । পরে পুরান ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভর্তি হন।
সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই কলেজ তার মতো গরীবদের জন্য নয়। এখানে ক্লাস হয় না কোনো। সবাই প্রাইভেট পড়েই কভার করে। গৌরাঙ্গ তার ভাইকে জানালেন যে, "আমাকে এখান থেকে টিসি নিয়ে গ্রামে পাঠাও, নতুবা আমাকে প্রাইভেট পড়াও।" তখন বড় ভাই তাকে বললেন যে, "তোর গ্রামে যাওয়া হবে না। এখানেই পড়বি। তোকে প্রাইভেট দিব, তবে একমাসের জন্য। এরমধ্যেই যা করার করে নিবি।"
ক্লাস না করে ও মাত্র একমাস প্রাইভেট পড়ে ইন্টার পরীক্ষা দিলেন তিনি। যা হওয়ার ছিল, তাই হলো। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় এই যে, যে গৌরাঙ্গ গণিতে এত ভালো সেই গৌরাঙ্গ কিনা গণিতেই ফেল করলেন। বাড়ি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তাকে আর পড়ানো হবে না। বরং কাজ করে সংসারে সাহায্য করবে। কিন্তু তিনি পড়বেন। এভাবে ছয়মাস সিদ্ধান্ত নিতেই ব্যয় হলো। দ্বিতীয়বার এইচএসসি দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু বিধিবাম, পরেরবারও তিনি ফেইল করলেন।
তখনকার সময়ে নিয়ম ছিল, পরপর তিনবার ফেইল না করলে কলেজ থেকে কাগজপত্র তোলা যেত না। গৌরাঙ্গ মনঃস্থির করলেন, যেভাবেই হোক কাগজপত্র তুলে গ্রামে গিয়ে ভর্তি হবেন। কলেজের একজন কর্মচারীর কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন, "অফিসে গেলে অনেকেই টাকা পয়সা চাইবেন, কিন্তু কাজ হবে না। তারচেয়ে বরং আপনি বোর্ড থেকে অমুকের একটা স্বাক্ষর নিয়ে আসেন, আমি কাগজ তুলে দিব।"
অফিস খোলার আধাঘণ্টা আগে সেখানে পৌঁছলেন তিনি। হাতে একটা দরখাস্ত। অফিসার সব শুনে বললেন, "এভাবে কাগজপত্র তোলার নিয়ম নেই। আর একবার পরীক্ষা দাও, পাশ করলে তো করলাই, আর না করলে তবুও কাগজপত্র তুলতে পারবা।"
শ্রাবণের আকাশ সেদিন অঝোরে কাঁদতে লাগল। অফিসারের রুম থেকে বের হয়ে বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। সকাল ১১টার দিকে একজন কর্মকর্তা তাকে দেখে অফিসে ঢুকেছিলেন, বিকেলে বের হয়েও তাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। সবকিছু শুনে তার মন গলল। তিনি অফিসারকে অনুরোধ করে স্বাক্ষর নিয়ে দিলেন।
গল্পের আসল টুইস্ট অপেক্ষা করছে এরপরই। গ্রামে এসে কলেজে ভর্তি হতে ছয়শত টাকা লাগবে, কিন্তু বাড়ি থেকে আর টাকা দিবেই না। এমন সময় এগিয়ে আসেন একই পাড়ার এক বিত্তবান বন্ধু। গৌরাঙ্গকে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য পাঁচশত টাকা দেয় সে। এই টাকার ব্যাপারে গৌরাঙ্গ দাদা বলেছেন, "আমি আমার নিজ অবস্থান থেকে অনেকের জন্য অনেক কিছু করেছি। কিন্তু ঐ পাঁচশত টাকার ঋণ আজও শোধ করতে পারিনি। কখনোই পারব না।"
রাস্তা দিয়ে যখন তিনি হাঁটতেন, গ্রামের ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে হাসাহাসি করত। সহপাঠীরা তাকে "আদু ভাই" বলে ডাকত। আজীবন প্রথম বেঞ্চে বসে অভ্যাস তার। কলেজেও প্রথম বেঞ্চে বসতে শুরু করেন, কিন্তু তাকে প্রথম বেঞ্চে দেখলে সহপাঠীরা ঐ বেঞ্চে আর কেউ বসত না। বাড়ি থেকে প্রায় ১৫দিন কলেজ করার পর একদিন রাতে খেতে বসেছেন, তার বড় ভাই মাকে বললেন যে, ওরে ভাত দিও না। ওরে ছাই খাইতে দাও।" তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বাড়িতে আর থাকবেন না৷ এই কঠিন সময়েও তার এক কলেজ ফ্রেন্ড এবং এলাকার এক বড় ভাই তাকে অনুপ্রেরণা দেন। বুকে সাহস সঞ্চয় করিয়ে দিয়ে বলেন যে, তুই পারবি। শুধু লেগে থাক।
কলেজের এক স্যারকে অনুরোধ করে লজিংয়ের ব্যবস্থা করে নেন। সেসময় বাড়ির ছেলেমেয়েকে দুই বেলা পড়ানো ও কলেজে ক্লাস করা- এসব বাদ দিয়ে তিনি দিনে ১০ঘণ্টা করে পড়তেন। যতক্ষণ অব্দি ১০ঘণ্টা হয়নি, ঘুমোতে যেতেন না। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন যে, এই বাড়ির আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। শুধু স্যারের কথা রাখতে গিয়েই তাকে লজিং রেখেছেন। তাই একসময় তিনি সেই বাসা থেকে চলে আসেন৷
এবার ওঠেন তার এক বান্ধবীর বাসায়। তাদের দোতালা বাড়ি ছিল। সেখানে একটা ঘরে থেকে পড়াশোনা করতে থাকেন। এদিকে গ্রামের মানুষ নানান কুৎসা রটাতে থাকে। ফলে সেই বাসাও ছেড়ে দিতে হয়। এবার তিনি অকূল পাথারে পড়ে যান। কলেজ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন হোস্টেলে একটা সিটের জন্য, কিন্তু হোস্টেলে কোনো সিট ফাঁকা নেই। পরে সহপাঠীদের এভাবে ম্যানেজ করে একটা সিটের বন্দোবস্ত হয় যে, আমি সারাটাদিন বাইরে থাকব, শুধু রাতে একটু থাকার জায়গা হলেই হবে।
থাকার চিন্তার ইতি ঘটল। এবার শুরু হলো খাওয়ার চিন্তা। হোস্টেলে প্রতিবেলা খেতে ১০টাকা করে লাগত। কিন্তু তার কাছে একটা কানাকড়িও ছিল না। এমনও সময় গেছে, দুইদিন-তিনদিন ধরে শুধু পানি খেয়ে ছিলেন। কলেজের অদূরেই এক জেঠাতো বোনের বাসা ছিল, দুই-তিনদিন পর তার বাসায় যেতেন। ভাই আসছে বলে বোন খেতে দিত, ওটুকু খেয়েই দিনযাপন করছিলেন।
এমন সময় এক শিক্ষকের কল্যাণে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা টিউশনি পান। ছাত্রের বড় ভাই বিদেশে থাকে, মাসে ৫০০ করে টাকা দিবেন। গৌরাঙ্গ লুফে নেন এই সুযোগ। এবার তিনি হোস্টেলে একবেলা করে খেতে শুরু করেন, বাকি টাকা জমিয়ে রাখতেন, যদি কখনো টিউশনি চলে যায়, তখন যেন কিছুদিন চলতে পারেন। ছাত্রের বাসা যাওয়ার পথে একটা নদী পড়ত, সেই নদী পাড় হতে ২টাকা ভাড়ার প্রয়োজন ছিল। টিউশনিতে তিনি একটা গামছা নিয়ে যেতেন। যাওয়ার সময় নৌকা করেই নদী পাড় হতেন, কিন্তু ফেরার পথে সাঁতরে আসতেন। তার মুখেই শুনুন, "সাঁতরে এ কারণেই আসতাম যে, নৌকা না চড়লে ৩০দিনে আমার ৬০টাকা বাঁচবে। আর ৬০টাকা হলে আমি ৬বেলা খেতে পারব।"
হোস্টেলে যে সময়টা ছিলেন, একটা দিনও তিনি সকালের মিল খাননি। বন্ধুদের বলতেন, "ডাক্তার আমাকে সকালে খেতে বারণ করেছেন।" বন্ধুরা যখন খেত, তখন তিনি বাইরে বেরিয়ে যেতেন।
এত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও তিনি কলেজে ভালো রেজাল্ট করতে থাকেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ অন্যান্য মেধাবী ছাত্রকে কলেজ থেকে বৃত্তি প্রদান করা হলেও তাকে দেওয়া হতো না, কারণ তিনি ফেইল করা ছাত্র। এক শিক্ষকের অনুরোধে কলেজ কর্তৃপক্ষ তার প্রতি সদয় হোন। ফলে তার আর খাওয়ার চিন্তাও রইল না।
টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো। এরই মাঝে তার এক স্যার বাইরের কলেজে গিয়ে প্রথম প্যারার সেই ঘোষণা দিয়ে আসলেন। তারপর তাকে ডেকে বললেন, "গৌরাঙ্গ, আমি এভাবে বলে আসছি। তুই আমার মান রাখিস।" স্যারের কথা তার মনে প্রভাব ফেলল। এখন তার থাকারও চিন্তা নেই, খাওয়ারও চিন্তা নেই, টিউশনিও নেই কোনো।। দিনে ২২ঘণ্টা(!) করে পড়তে শুরু করলেন। হ্যাঁ ভাই, ঠিকই পড়েছেন, ২২ ঘণ্টা! এক থেকে দেড় ঘণ্টা ঘুমোতেন, বাকি পুরোটা সময় পড়তেন। বোর্ডিং গিয়ে খাবার আনলে যেতে-আসতে দুই-তিন মিনিট সময় নষ্ট হবে জন্য, কাজের বুয়া তার ঘরে খাবার দিয়ে যেত!
বাড়ি থেকে মাত্র ৩-৪ কি.মি. দূরে থাকা সত্ত্বেও এই দুটো বছরে তিনি বাড়ি গিয়েছিলেন মাত্র দু'বার। একবার মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে, আরেকবার পরীক্ষার আগের দিন মায়ের সাথে দেখা করতে। এছাড়া মাঝেমাঝে পাশের বাজারে গিয়ে বাড়ির খোঁজখবর জেনে আসতেন। ইতোমধ্যে গতবছর তার ছোট ভাই এইচএসসিতে কুমিল্লা বোর্ডে সপ্তম হয়েছেন। গৌরাঙ্গের মাথায় সবসময় কাজ করত, অন্তঃত ছোট ভাইয়ের চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। এমতাবস্থায় পরীক্ষার আগের দিন তার মা যখন বললেন যে, "এমন রেজাল্ট করবি, যেন অমুকের মতো সাংবাদিকরা এসে ছবি তুলে নিয়ে যায়", তখন প্রথম হওয়ার সংকল্পটা আরও দৃঢ় হয়ে যায়।
তার ছোট ভাই নিজের বন্ধুবান্ধবদের কাছ হতে অনেক বই সংগ্রহ করে তাকে দিয়ে সাহায্য করেন। পরীক্ষার কিছুদিন আগের ঘটনা। স্যার তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
- অমুক বইয়ে ৫৫টা প্রশ্ন আছে, সবগুলো পড়েছিস তো?
- ৫৪টা পড়েছি, স্যার।
স্যার তখন রাগে তাকে দুটো থাপ্পড় মারলেন।
- স্যার, পরীক্ষায় ১০টা প্রশ্ন আসবে, উত্তর করতে হবে ৫টা। এটা সহ আসলেও তো আমার ৯টা প্রশ্ন কমন থাকবে।
স্যার তখন আরও একটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন, "এটাও মুখস্থ করতে হবে।"
যথারীতি পরীক্ষা শুরু হলো। গৌরাঙ্গের সিট পড়ল শেষবেঞ্চে। তিনি এসে মেজিস্ট্রেটের কাছে কেঁদে কেঁদে বললেন, "স্যার, আমি সামনের বেঞ্চ ছাড়া পরীক্ষা দিতে পারি না।" মেজিস্ট্রেট সিট বদল করে দিলেন এবং প্রতিটি পরীক্ষায় এসে তার খোঁজ নিতেন। হলগার্ডকে বলে দিয়েছিলেন যে, গৌরাঙ্গকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে! আপনি জেনে অবাক হবেন, যেদিন পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়, সেদিন মেজিস্ট্রেট নিজেই তাদের কলেজে এসেছিলেন শুধু গৌরাঙ্গের রেজাল্ট জানার জন্য।
তখনকার সময় নিয়ম ছিল, বোর্ডে যে ফার্স্ট হতো, রেজাল্টের দিনই বিটিভিতে তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হতো। রেজাল্টের কয়েকদিন আগেই গৌরাঙ্গ ঢাকায় তার স্যারের বাসায় চলে যান। রেজাল্টের আগের রাতে তিনি একটা ভালো শার্ট আয়রন করে এনে রাখেন, যাতে সেটা পরে সাক্ষাৎকার দিতে যেতে পারেন। চিন্তা করুন একবার, কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস!
রেজাল্টের দিন সকালবেলা তিনি বাইরে চলে যান। বাসায় এসে স্যারের স্ত্রীর মুখে জানতে পারেন, তিনি অষ্টম হয়েছেন। মন পুরোই খারাপ হয়ে যায় তার। একটুপর স্যার ফোন করে গৌরাঙ্গকে বলেন, "তুমি আমার মান রেখেছ, তুমি ফার্স্ট হয়েছ বোর্ডে।" নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। স্যারের স্ত্রী অবাক হয়ে স্যারকে বললেন, "তাহলে যে তুমি বললে যে, গৌরাঙ্গ অষ্টম হয়েছে?" স্যারের প্রত্যুত্তরটি আপনার শরীরে শিহরণ জাগাতে বাধ্য। তিনি বললেন,"আমি এটা চাইনি যে, গৌরাঙ্গ ফার্স্ট হয়েছে, এটা সে আমি ছাড়া অন্য কারও মুখ থেকে শুনুক!"
গল্পের খানিকটা এখনো বাকি আছে। এরপর মাত্র ২৫-২৬ দিনের প্রিপারেশন নিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হোন। এটা ২০০০ সালের ঘটনা। ম্যানেজমেন্টের একটা ম্যাথের বই ১৯৭৪ সাল হতে পড়ানো হতো, যেটার কোনো সল্যুশন বের হয়নি। তিনি দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন সেই ম্যাথের বইটার সল্যুশন বের করেন। বইটিতে ইন্টিগ্রেশন, ডিফারেন্সিয়েশন ইত্যাদি জটিল জটিল বিষয় ছিল, যা সাধারণত কমার্সের ছাত্ররা পড়ে না। কিন্তু গৌরাঙ্গের মাথায় একটা জেদ কাজ করত যে, আমি গণিতে ফেল করেছি! গণিতকে আমি দেখে নিব!
যে গৌরাঙ্গ একসময় মাত্র ২টাকা বাঁচানোর জন্য সাঁতরে নদী পাড় হতো, সেই গৌরাঙ্গ এরপর শুধু প্রাইভেট পড়িয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করতে শুরু করেন। তিনি ১৫০ জন ছাত্রছাত্রীকে পড়াতেন, তন্মধ্যে ৫০ জনকে ফ্রি পড়াতেন। কারণ, জীবনে টাকার ক্রাইসিসটা তিনি খুব ভালো করে অনুধাবন করেছেন। ঢাবি থেকে অনার্স-মাস্টার্স কম্পলিট করে তিনি সম্পূর্ণ নিজের টাকায় লন্ডন থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসেন।
এরপর কর্মজীবনে যোগ দেন ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে কয়েকবছর শিক্ষকতা করে ভারতে গিয়ে পিএইচডি করে আসেন। বর্তমানে তিনি সেখানকার ডিপার্টমেন্টাল হেড হিসেবে কর্মরত আছেন।
এই সুদীর্ঘ লেখাটি যারা কষ্ট করে পড়লেন এতক্ষণ যাবত, তাদের প্রতি একটাই অনুরোধ থাকবে, জীবনে কখনো আশাহত হবেন না। সৃষ্টিকর্তা যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। আপনার কাজ শুধু সৎভাবে শ্রম দিয়ে যাওয়া। গৌরাঙ্গ দেবনাথ এটাই বলছিলেন যে, "আমি যদি প্রথমবারেই পাশ করতাম, তাহলে হয়তো আজকের এই অবস্থানে থাকতাম না।"
জীবনে চড়াই-উতরাই আসবেই। এসব পেরিয়ে যারা অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে, তারাই একমাত্র জীবনে সফল হবে। ইতিহাসে তাদের নাম জ্বলজ্বল হরফে লেখা থাকবে। আর যদি আপনি হাল ছেড়ে দেন, তাহলে ব্যর্থতার চোরাবালিতে ডুবে যাবেন। জীবন আপনার, তাই সিদ্ধান্তও আপনার। ভেবে দেখুন, ইতিহাস হবেন? নাকি হারিয়ে যাবেন অন্ধকারের অতল গহ্বরে!
সত্যি গৌরাঙ্গ দেবনাথ আমাদের কাছে সফলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । জ জীবনে যতই চরাই উতরাই আসুন না কেন আপনি যদি একাগ্রতার সাথে এগিয়ে যান তাহলে সফলতা আপনার একদিন আসবেই.....