"ডাকাত পড়েছে মোল্লা বাড়িতে।
শিপার বিয়ে আজ। সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি। কালো মেঘের মতোনই থমথমে মুখ নিয়ে সেজেগুজে বসে আছে মেয়েটা। মন ভালো নেই একদম। এই বিয়েতে তার মত নেই। পালাবে সে। কোনো পরিকল্পনা নেই এই নিয়ে। পছন্দের মানুষ সাদি হাজির হয়েছে বিয়ে বাড়িতে জানা গেছে এই খবর। শিপার সাথে যোগাযোগ করেনি এখনো ছেলেটা। তবে করবে। আর করলেই দুজন মিলে দেবে ছুট। বাবার তখন কী হবে? হার্ট অ্যাটাক নিশ্চিত!
শিপা, বসে বসে এইসব হাবিজাবি কথা ভাবলেও ডাকাতি হতে পারে এমন বিপদের কথা ভাবেনি একবারও। ভাবার কথাও না অবশ্য। ডাকাত কী বলে কয়ে আসে?
রাত পোহালেই শিপার বিয়ে।চারিপাশে সুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। কোথাও কেউ নেই মনে হচ্ছে।
মাঝরাতে এই গ্রামটা মৃত্যুপুরীর ন্যায় হয়ে গেছে।
গ্রামের সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন।শুধু মাত্র শিপার চোখে ঘুম নেই।দম বন্ধ হওয়া একটা অস্বস্তি কাজ করছে।
জানালার গ্রিল ধরে শিপা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো আকাশের দিকে স্থির, চোখে পলক পড়ছে না।আজ আকাশের চাঁদটা ভরপুর মায়ায় বাঁধানো।জ্বলজ্বল করছে কাঁসার থালার মতো,এতো সুন্দর রাতটা সুখের রাত হওয়া দরকার কিন্তু বাস্তবে তা আর হলো কই,এই রাতটা সবচেয়ে কষ্টের রাত মনে হচ্ছে শিপার কাছে, মায়ের কথা খুব মনে পরছে।
জ্যোৎস্নার এক চিলতে আলো শিপার মুখে এসে পরেছে।চোখের পানি গুলো কপোল গড়িয়ে চিকচিক করছে।
সাদির কথাও খুব মনে পরছে। মন খারাপের গলি গুলো প্রচন্ড বিষাক্ত একটার সাথে একটা বাঁধা,একটাই টান লাগলে আর একটা এসে হাজির।
শিপা চোখের পানিটা মুছে নেয়, আর মনে মনে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বলে বাবা সম্পর্কটা মেনে নিলে কি হতো?পুরনো ক্ষত মনে রেখে কেন আমাকে এভাবে শেষ করছো।
সাদি দের সাথে পারিবারিক অশান্তি আছে।এই জন্যেই শিপা কে এতোদিন গ্রামের বাইরে রেখেছিল।
দিনটা কোন কাল বৈশাখীর ঝড়ের দিন ছিলোনা।কিন্তু ঝড় উঠেছিলো।ভয়ংকর এক ঝড়,যেই ঝড়ে কেড়ে নিয়েছিলো শিপার মায়ের প্রাণ,
শিপার ছোট চাচা ঢাকায় চাকরি করে।সেই সূত্রে ঢাকায় থাকে শিপার চাচিকে নিয়ে।
শিপার চাচি প্রেগন্যান্ট, অবস্থা ক্রিটিকাল অনেক টাকা লাগবে। আর ঢাকাতে আপন বলতে কেউ নেই।এমন একটা সংবাদ শুনেই শিপার বাবা বসে থাকতে পারেনি।ফোন পাওয়ার পর পরই রওনা দিয়েছিলো ঢাকার উদ্দেশ্য।
শিপার বয়স তখন ৩ বছর।
রাতটা ছিলো অনেক মায়াময় রূপে চাঁদটা নিচে নেমে এসছিল মনে হচ্ছিল।আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলো না।
চাঁদের আলো চিকচিক করছিলো।শিপাকে নিয়ে শিপার মা ঘুমিয়ে আছে।মাঝ রাতে দরজার বাইরে কারো গোঙরানোর আওয়াজ পায়।
শিপার মা দরজা খুলে দেখে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ গা এলিয়ে পড়ে আছে দরজার বাইরে,শিপার দাদা পাশের ঘরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল ঘুমের ঔষধ খেয়ে।শিপার মা অনেক বার ডেকেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।শিপার মা তাড়াতাড়ি করে লোকটার চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়।লোকটা চোখ খুললে শিপার মা লোকটাকে ধরে বসানোর চেষ্টা করে ঠিক সেই সময় কিছু লোক আড়াল থেকে বার হয়ে এসে বাজে মন্তব্য করে।আর চিল্লাচিল্লি করে গ্রামের লোক জড়ো করে। শিপার মাকে আর ওই লোকটাকে একটা পোলের সাথে বাঁধে।মানুষের টানা হিচড়াতে শিপার মায়ের ওরনা টা পড়ে যায়।অনেক মানুষের ভিড়ে কিছু কালো হাত শিপার মাকে আক্রমণ করতে পিছ পা হয়নি। কেউ পাশে ছিলো না সেই রাতে।
শিপার দাদার শরীর খারাপ ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। ঘুম ভেঙে এইসব দেখে শিপার দাদা স্তব্ধ, শিপার দাদা চিৎকার করে বলেছিল আমার বউমা এইটা করতে পারে না। ছেড়ে দাও আমার বউমা কে।
সেইদিন শিপার দাদার কথা কেউ শোনেনি।শোনেনি শিপার মায়ের আর্তনাদ।
বিনা মেঘে সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হয়েছিল।
সারাটারাত পোলের সাথে বেঁধে রেখেছিল শিপার মাকে।সকালে স্কুল মাঠে বিচার বসবে গ্রামের সবাই এই কথা করণ করে।ভোরের দিকে শিপার মাকে একটা ঘরে আটকিয়ে রেখেছিল।সকালে সেই ঘরের দরজা খুলে শিপার মায়ের লাশ পেয়েছিল।ফ্যানের সাথে ঝুলে ছিলো।
মঞ্জুরুল মোল্লা সেদিন একটুও ভেঙে পড়েনি। চিৎকার করে কাঁদেনি।শুধু শিপা কে বুকে আকড়ে এইটার শেষ দেখেছিলেন।
কিভাবে সাদির বাবার ফাঁদে পা দিয়ে গ্রামের সবাই একটা নিরীহ মানুষের প্রাণ নিলেন।
সাদির বাবার ০৫ বছরের জেল দিয়েছিলেন।এই খান থেকে তাদের শত্রুতার সূত্রপাত। আগে ছোট খাটো ঝামেলা ছিলো।এইসবের জন্যে শিপার বাবা শিপা কে খালাম্মার বাসায় রেখেছিল।শিপা এইসবের কিছুই জানতো না প্রথমে,পরে সবটা জানলেও মন থেকে সাদিকে মুছতে পারেনি।শিপার মন একটা কথাই বলেছিল সাদি তো অপরাধী না।
শিপা জানালায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলো শুধু
ভোরের আলো ফুটে গেছে অনেকক্ষণ হলো,কিন্তু আকাশের অবস্থা খারাপ চারিপাশে কালো মেঘ আর ঝুম বৃষ্টি ভোর থেকে,,
একেক জন একেক রকম কাজে ব্যস্ত বিয়ে বাড়ি বলে কথা।বৃষ্টির জন্য অনেক সমস্যাও হচ্ছে।কিন্তু সমস্যা ভেবে বসে থাকলে হবে না।সমস্যা টা অতিক্রম করতে হবে।
মঞ্জুরুল মোল্লা শিপার বাবা প্রত্যেকটা আত্নীয় দের কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন।সেই মোতাবেক সবাই কাজ করছে।
বাড়ির চারিপাশে আনন্দের সুবাসে মৌ মৌ করছে।ভাবি আর দাদিরা মিলে শিপা কে হলুদ মাখিয়ে গোসল করিয়ে দিলো।
শিপা ঘরে বসে চুল গুলো শুকোচ্ছে আর সাদির কথা ভাবছে। শিপা খবর পেয়েছে সাদি এসেছে।কিভাবে কি করবে। কোন পরিকল্পনা নেই। এই গুলো নিয়েই ভাবনায় মগ্ন শিপা,
কিছুক্ষণের মধ্যে সাদির দেওয়া একটা চিঠি পায় শিপা।
বর পক্ষ চলে এসেছে।
চারিপাশে কালো মেঘ ঝুম বৃষ্টি সাথে বর্জপাত বিদঘুটে অন্ধকার,
শিপা কণের সাঁজে কালো মেঘের মতোনই থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ি জুড়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে ডাকাত পরেছে।
সবাই স্তব্ধ দিনের বেলায় ডাকাত! তাও এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে,আজ অবধি এই গ্রামে এমনটা হয়নি।
বর পক্ষের সবাই ভয়ে চুপসে গেছে।
ডাকাত? কোথায় ডাকাত, সবার মুখে একই কথা। শিপার বান্ধবী রোমানা কাঁপতে কাঁপতে এসে বলল শিপার ঘরে ডাকাত পরেছে।শিপার বিয়ের সব গয়না নিয়ে গেল। মাংকি টুপি পড়া আর হাতে পিস্তল নিয়ে একদল ডাকাত এসেছিল।পিছনের ছোট গেট দিয়ে চলে গেল।
মঞ্জুরুল মোল্লা তড়িঘড়ি করে শিপার ঘরে গেল।শিপার ঘরে যেয়ে শিপার বাবা হতবাক শিপা ঘরে নেয়।
মঞ্জুরুল মোল্লার মাথায় হাত কি
অবস্থা হলো এইটা শিপা কই?
শিপার বাবা ধীর পায়ে শিপার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো। বর পক্ষের সবাই শিপার খোঁজ করছে। শিপার কিছু হয়নি তো,সবাই স্থির ভাবে বাড়িটায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।
লাল টুকটুকে বেনারসি পড়ে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে একজন বালিকা হেঁটে আসছে। মনে হচ্ছে পুরো অপ্সরী এই অপ্সরী কে কালো মেঘ ঝুম বৃষ্টির মধ্যেও চিনতে অসুবিধা হলো না শিপার বাবার, মেয়েকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।
শিপা পুরো পাথর হয়ে গেছে। কিছু বলছেনা।
- শিপা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কি বলবে তাঁর জানা নেই।
পাশ থেকে শিপার খালাম্মা আফরোজা বললেন, এইভাবে সময় নষ্ট না করে বিয়েটা পড়ানো হয়ে যাক তারপর এইসব নিয়ে কথা বললেই হবে।শিপার খালাম্মা কিছুটা আঁচ করেছে।
কারণ ডাকাতি হলে সবার কাছে আসবে। সবার জিনিস নেবে শুধু মাত্র শিপার তাই নিবে না।কিছু একটা গন্ডগোল আছে।
বর পক্ষের একজন মহিলা কর্কট কন্ঠে বলে উঠলেন, মেয়ের সব গয়না বিয়ের আসরে হাজির করেন এখন, তারপর বিয়ে পড়ান।আর আপনাদের মেয়ে ডাকাতের পিছুই বা কেন গেছিলো?
শিপা নিচু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখে জল চিকচিক করছে।
শিপার হবু বর আহান শিপার মুখের দিকে চেয়ে আছে। শিপার মুখটা খুব মায়াবী লাগছে।
আগপিছ না ভেবে আহান বলল এখনই বিয়ে হবে।আর গয়নার মিমাংসাটাও হবে।আহানের উপরে আর কেউ কথা বলতে পারলেন না।বিয়ের কার্য্য শেষ হয়।
আহান সবটা না বুঝলেও কিছুটা বুঝতে পেরেছে।সবটা ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল।একজন অসহায় বাবা আর তার মেয়ের মুখটা যে বড্ড মায়াবী দেখাচ্ছিল।এই অসময়ে পাশে না দাড়ালে নিজেকে যে বড্ড অপরাধী মনে হতো।
শিপা এক পলক আহানের দিকে তাঁকায়,মানুষ কতটা বিচিত্র হতে পারে। যাকে ৩ টা বছর ভালবাসলো সেই তার ভালবাসার মূল্য দেয়নি। তাকে ঠকিয়ে পালিয়ে গেছে।
গয়না নেওয়াটা ছিলো তার আসল উদ্দেশ্য যেন বিয়েটা না হয়।আর শিপা কে অপয়া বলতে পারে পুরো গ্রামবাসী,তারপর যেন মেয়ের কথা ভেবে মঞ্জুরুল মোল্লা সাদি দের বাড়িতে যেয়ে পা ধরে তার মেয়ে কে বিয়ে করতে বলেন।
ডাকাতের রূপে সাদি তার বন্ধু দের নিয়ে শিপার চরম সর্বনাশ করার উদ্দেশ্য হাজির হয়েছিল।
শিপা আহান কে ঠকাতে চেয়েছিল,কিন্তু সেই আহান-ই আজ তার বাবার মানসম্মান রক্ষা করল।
শিপা আহানের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে শুধু একটা কথায় বলেছিলো এই মানুষটাকে সারাটাজীবন পাশে চাই।
অবশেষে দুজন নব দম্পতি একই সুতোই বাঁধা পরল।
Darun likheso apu golpo gula onek joss...ami tomar golpo porbo aj theke amk niyew ekta golpo likhba please