শাহজাদপুর উপজেলা পরিষদটি আলাদাভাবে একটি নদীর পাড়ে অবস্থিত। তার কিছু দূরেই একটি মাঠের পাশে পরিত্যক্ত একখানা আটচালা টিনের ঘর। আগে এটাকে বোর্ড অফিস বলা হতো কিন্তু উপজেলা পরিষদটি হয়ে যাওয়ায় এখন আর এটা তেমন কোন কাজে আসে না তাই কয়েক বছর হলো ঘরটি তালা বন্ধ হয়ে একা একা পড়ে আছে। বারান্দার সামনে একটি কাঁঠাল গাছ। বোর্ড অফিসের মাঠে সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। টিউবওয়েলের পাড়টা বেশ সুন্দর পাকা শান বাঁধানো। হাটের দিন অনেকেই সেখানে জল খায়। মাঠের ওপাড়েই একটি ছোট্ট বাজার। হোটেলের লোকেরা অনেক সময় বালতি করে এখান থেকে জল নিয়ে যায়।
বোর্ড অফিসের এই বারান্দায় সারাক্ষণ বসা থাকে একটি পাগল আর তাঁর সাথে একটি লেংড়া কুকুর। পাগলটি যে কোথা থেকে এসেছে তা কারো জানা নেই। তবে অনেক দিন হলো সে সকলেরই চেনা। সে কাউকে তেমন কিছু বলে না। শুধু ক্ষিদে পেলেই ঐ বারান্দা থেকে নামে এছাড়া আর সহজে সে ঐ বারান্দা থেকেও নামতে চায় না। সারাক্ষণ দূরের খেয়া ঘাটের দিকে এক নজরে চেয়ে বসে থাকে। তাঁর মাথায় উসকো খুসকো লালচে চুল। মুখে সামান্য সামান্য দাড়ি গোঁফ। গায়ে সারা বছর একখানা ছালা পেঁচানো। সে কারো সাথে কথা বলে না। মাঝে মাঝে টিনের থালা হাতে খেয়া ঘাটে এসে দাঁড়ায়। লোকেরা চলতি পথে তাঁকে যে যা ইচ্ছে কিছু দিয়ে যায়।
কুকুরটিও এক সময় বাজার দিয়ে বেশ সুন্দর স্বাচ্ছন্দেই ঘুরে বেড়াত। হোটেলে হোটেলে ঘুরে লেজ নেড়ে নেড়ে হাড্ডি গুড্ডিসহ উচ্ছিষ্ট খেত। তারপর অধিকাংশ সময় বাজারের পাশে একটি আম গাছের তলায় গিয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকত। একদিন দারগা সাহেবের জীপ গাড়ীটি ভাঙ্গা রাস্তা এড়িয়ে আম গাছের নীচ দিয়ে অতিক্রমের সময় ঘুমন্ত কুকুরের পিছনের পা দুটি একেবারে পিষে দিয়ে গেল। সেই থেকে কুকুরটি কোনরকম বেঁচে থাকলেও আর একটুও দাঁড়াতে পারেনা। সাঁতার কাটারমত করে সামনের পা দুটো দিয়ে বুক ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে কোনরকমে চলে। চলার সময় কোমরের পিছন অংশে পা দুটো লেজসহ নির্জীব বস্তুরমত মাটিতে লেপটাতে থাকে।
পাগলের সাথে সাথে কুকুরটিরও আশ্রয় এখন এই বোর্ড অফিসের বারান্দা। এক সঙ্গে থেকে থেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রাণী দুটির মধ্যে যে কী এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা কারোই নেই জানা। এমন কী ব্যস্ত মানুষগণও কখনো একবার তা কালক্ষেপণ করে বুঝে দেখার চেষ্টা করেনা। তবে ওরা দুজন দুজনাকে যেন খুব উপলব্দি করে। কী এক প্রকার অব্যক্ত নীরব ভাষায় যেন তাদের মধ্যে কথা হয়।
কনকনে শীতের রাতে শানের বারান্দায় নীচ থেকে ঠান্ডা ওঠে। কুকুরটি তখন ওম পেতে সরে আসে পাগলের কাছে। পাগলটিও মাথার নীচে রাখা আরেকখানা ছালা ছূঁড়ে দেয় ওর দিকে। কুকুরটি চোখ পিটপিট করতে করতে গিয়ে গুটিশুটি জড় হয় তার উপর। শীতের সকালে রোদ উঠলে পাগলটি মাঠে নেমে এসে রোদ পোহায়। কুকুরটিও তখন ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে ওর পাশে এসে অবস্থান নেয়।
হাটের দিন সকাল থেকে লোকজনের আনাগোনায় মাঠ একেবারে ভরে যায়। পাগলটি মাঠের আনাচে কানাচে জ্বলন্ত বিড়ির পাছা খুটে খুটে নিয়ে, চোখ বুজে একা একা টানে। কেউ দয়া করে টিনের থালায় কিছু দিয়ে যায়, অনেকে আবার ডেকে নিয়ে দু একটি রুটি কিনে দেয়। কুকুরটিরও তখন কিছু সুবিধে হয়। হাট শেষে মাঠের উপর দিয়ে খাওয়ারমত উচ্ছিষ্ট অনেক কিছু পড়ে থাকে, পরের দিন কুকুরটি মাঠের মধ্যে খুঁজে খুঁজে সেইগুলো চেটে চেটে খায়। তখন ওর বিরোধ বাঁধে শুধু কাকগুলোর সাথে। ওরা এসে জোর করে ভাগ বসায়। ঝড়ের সময় ঝাপটা এসে বারান্দা ভিজিয়ে দেয়। তখন গা বাঁচাতে ওদের দুজনকেই বেড়ার গায়ে চেপ্টা হয়ে মিশে থাকতে হয়।
বর্ষার দিনে খুব কষ্ট হয় ওদের, তখন সব কিছু থাকে বৃষ্টিভেজা, চারিদিকে কাদা থ্যাক থ্যাক করে। মাঝে মাঝে অঝরে বৃষ্টি নামলে টিনের চালায় একটানা শব্দ হয়। পাগলটি তখন শুধু পড়ে পড়ে ঘুমায়। কখনো কখনো বারান্দায় উঠে আসে গুঁই সাপ কিন্তু কুকুরটি পাগলকে নিরাপদ করতে ঘেউ ঘেউ করে ওদেরকে তাড়িয়ে দেয়। ক্ষুধার তাগীদে পাগলটি অনেক সময় বৃষ্টিতে ভিজেই নেমে যায় বাজারে। দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ পরে ফিরে আসে ঠোঙ্গা ভর্তি চিড়ে মুড়ি আর গরম রুটি নিয়ে। বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে সে আহার করে আপন মনে। দু একটি রুটি ছুঁড়ে দেয় কুকুরটির দিকে, কুকুরটিও চোখ বুজে বুজে ওর সাথে সাথে শুকনো রুটি চিবায়।
চৈত্রের দুপুরে প্রচন্ড গরমে পঙ্গু কুকুরটি তৃষ্ণায় হাঁপাতে থাকে। পাগলটি সেই সময় উঠে গিয়ে টিউবওয়েল থেকে টিনের থালায় জল এনে কুকুরের সামনে রাখা মাটির বাসনে ঢেলে দেয় ও তখন মাথা তুলে চেটে চেটে জল খায়। কোন বাড়ী থেকে খাবার দিলে পাগলটি তা কিছুটা বাঁচিয়ে কলার পাতায় মুঠি করে কুকুরের জন্য নিয়ে আসে। ওপাড়ার কুকুরগুলো দল বেঁধে মাঠ অতিক্রম করার সময় বোর্ড অফিসের সামনে এসে পঙ্গু কুকুরটিকে লক্ষ করে চারিদিক ঘিরে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। পঙ্গু কুকুরটির প্রতিবাদ করার কোন ক্ষমতা নেই, তবুও সামান্য একটু মুখ তুলে দুই একবার ক্ষীণ কন্ঠে ভুকে ভুকে ও আবার চোখ পিটপিট শেষে মাথা নামিয়ে ফেলে। দুষ্টু কুকুরেরা ওর দিকে তেড়ে এলে পাগল নীচে নেমে একের পর এক ঢিল ছুঁড়ে সেগুলোকে তাড়িয়ে দেয়।
এইভাবে জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে করে বেঁচে থাকে গোত্রচ্যূত দুটি অসহায় প্রাণী। খাদ্য ছাড়া এ জগতে তাদের আর তেমন কোন একটি চাহিদা নেই। নিরীহ আর অসহায়ত্বের ভিত্তিতেই জাতভিন্নতা সত্বেও তাদের এই সহঅবস্থান, এই পরস্পর সহযোগীতা আর এক সঙ্গে বসবাস। শুধুই নিরুপায় দুটি প্রাণীরূপে জগতের কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে, তারা হয়ত কোন শলাপরামর্শ ছাড়াই এখন একজোট। কেননা প্রাণের নূন্যতম চাহিদা মেটাতে তারা এক পর্যায়ে জোটভুক্ত হতে যে বাধ্য। অন্যদের কোন ক্ষতি না করে বরং তাদের সাথে একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তাদের এই যাপিত জীবনধারণ।
এইভাবে কাটে তাদের মাস, কাটে তাদের বছর। হয়ত সময়ের সাথে সাথে দুজনের প্রতি দুজনের উপলব্ধি আর অনুভূতি দিন দিন আরও বেড়ে যায়। দুজনের ভাষা দুজনের কাছে হতে থাকে আরও পরিষ্কার আরও স্বচ্ছ। ইংগিত হতে থাকে স্পষ্ট। ঘনিষ্ট হয় সম্পর্ক। বছর বছর বোর্ড অফিসের বারান্দায় পড়ে থাকা এই অবহেলিত প্রাণী দুটিকে নিয়ে ব্যস্ত গ্রামবাসী তেমন একটা মাথা ঘামায় না। এদের একই অবস্থায় একই স্থানে দেখে দেখে তারাও হয়ে ওঠে বেখেয়ালী অভ্যস্ত।
এরমধ্যে একদিন ম্যাজিষ্ট্রেটের দুষ্টু ছেলে চলতি পথে একটি কুকুরকে লাথি দিতেই প্রতিবাদী কুকুরটি ওর পা কামড়ে দেয়। এতে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব কুকুরজাতের উপর ভীষণ রাগান্বিত হয়ে পরের দিন ঢালাও হুকুম জারি করে --- সত্বর বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে মেরে মেরে ওদেরকে দূরে কোথাও ফেলে দেওয়া হউক। এই হুকুমের আওতায় অনেক নির্দোষ কুকুরও মারা পড়তে থাকে।
সেদিন গ্রীষ্মের দুপুরে দক্ষিণা হাওয়ায় বোর্ড অফিসের শানের বারান্দায় প্রতিদিনের মতই ওরা দুজনে ছিল ঘুমিয়ে। আজ সকালে হোটেলের মালিক সুবলদার কাছ থেকে পাওয়া গেছে চারটে বাসি রুটি, তাই ভাগাভাগি করে খেয়ে দুজনের এই নিরুদ্বেগ দিবানিদ্রা। আজ আর খাদ্যের অন্বেষণ না করলেও চলবে। কোথাও যাওয়ার আজ আর তেমণ কোন দরকারও নেই বরং এই গরমে ঝির ঝির বাতাসে নিরিবিলি বারান্দাতেই পড়ে থাকা শ্রেয়।
হঠাৎ খুব কাছেই উৎপন্ন হলো লোকজনের আনাগোনা আর সতর্ক পদচারণা তারপর ‘ক্যাক’একটি শব্দ হতেই পাগলের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জল্লাদের মত কয়েকজন লোক অক্ষম কুকুরটিকে ঘিরে দাঁড়ানো। একজন বাঁশের চেঙ্গী দিয়ে পঙ্গু কুকুরটির ঘাড় খামচে ধরা আরেক জন ততক্ষণে বড় মাপের ইনজেকশনটি পুরোপুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর গায়ে। পাগলটি কিছু বুঝে উঠার আগেই সব শেষ। দুর্বল পঙ্গু কুকুরটি কয়েক ঝাঁকি দিয়েই দেখতে দেখতে নিস্তেজ। ওর নিস্তব্দ নিস্পলক আধবোজা চোখ দুটো তখন কেবল পাগলটিকে উদ্দেশ্য করেই এক নজরে চাওয়া। কিন্তু বেশী সময়ও আর পাওয়া গেল না। পাগলের বিস্মিত হতভম্ব চোখের সামনেই লোকগুলো চ্যাংদোলা করে ওর নিথর দেহটিকে নিয়ে চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
অসহায় পাগলটি নির্বাক নির্জীব কাঠেরমত ঠাঁই বসে রইল আটচালার বারান্দায়। সামনে পড়ে রইল নির্দোষ কুকুরটির শীত নিবারণের সেই এক খন্ড ছেঁড়া ছালা, জল পানের সেই ভাঙ্গা মাটির খোরাটি আর আধ খাওয়া এক টুকরো শুকনো রুটি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো, সূর্য ডুবে গেল দূর পশ্চিম দিগন্তে। ঘাটের খেয়া নৌকাটিও রাত বাড়তে বন্ধ হয়ে গেল এক সময়।
পরের দিন থেকে ব্যস্ত গ্রামবাসীর চোখে ধরা পড়ল বোর্ড অফিসের বারান্দাটি যে হঠাৎ একেবারে খালি, একেবারে ফাঁকা। চলতি পথে কেউ কেউ থমকে দাঁড়াল শূণ্য বারান্দাটি দেখে। কুকুরটির কথা না হয় অনেকেই শুনল কিন্তু সেই সাথে এতো দিনের চেনা ঐ পাগলটি গেল কোথায় ? কয়েক দিন শত চেষ্টা, শত বলাবলি করেও কেউ আর পাগলটির কোন খোঁজ পেল না।
কোন বেদনায়, কোন উপলদ্ধিতে, কোন প্রতিবাদে সে যে গ্রাম ছেড়ে একেবারে চিরতরে চলে গেল তা সকলের কাছে রইল আজও অজানা।
---------
Wow,, very helpful article.. Please back me comment in my article please