আমার বাবা গানবাজনা পছন্দ করতেন না। পছন্দ করতেন শুধু খাওয়া দাওয়া। কিন্তু মনেরও যে একটা চাহিদা আছে তারও যে একটি আহার দরকার তা তিনি একদম বুঝতেই চাইতেন না। আমি মাঝে মাঝে বাড়ীর ছাদে উঠে পাশের বাসার রেডিও শুনে শুনে সেই চাহিদা যতদূর সম্ভব পূরণ করতাম। বিশেষ করে ক্রিকটের স্কোর শুনতে আমাকে প্রাই প্রাই ছাদে যেতে হতো। অনেক সময় ক্রিকেটের রেডিও কমেন্ট্রি শুনতে সাইকেল চালিয়ে শহরতলীর কোন বন্ধুর বাড়ীতেও যেতাম।
সে বেশ আগের কথা তখন আমরা খুব ছোট। সেই সময় টি.ভিতে এখনকার মত এমন লাইফ দেখানো হতো না। রেডিওই ছিল এক মাত্র মাধ্যম। আমতলায় ইটের স্ট্যাম্প বানিয়ে তক্তার ব্যাট দিয়ে টেনিস বল খেলে খেলে আমাদের ক্রিকেটের হাতে খড়ি। এরপর বলতে হয় নদীতে গোসল করতে গিয়েই অনেকটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশ। শীতের ঠান্ডা জলে নামতে যতটা সম্ভব বিলম্ব করতাম। তখন গোসলের আগে গুল নিতে নিতে নদীর পাড়ে রোদে বসা এক দল ক্রিকেট ভক্তের মুখে তর্ক বিতর্ক শুনে শুনে টেষ্ট ক্রিকেটের সাথে আমাদের পরিচয়।
তারপর দেখতাম পাড়ার কোন বড়ভাই একাগ্র চিত্তে রেডিওর সামনে উপুর হয়ে আছে। তাঁরপাশে দাঁড়িয়ে অনেক প্রশ্ন করে করে অনেক কিছু জেনে একটু একটু করে খেলা শুনতে শুনতে রেডিও কমেন্ট্রিও বুঝতে শুরু করলাম। এমন কি এরপর এক সময় বিশেষজ্ঞের মত বড়দের তর্কে বিতর্কে ঢুকে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মন্তব্য পর্যন্ত করতে লাগলাম।
এবার ক্রিকেটের তীব্র ক্ষুধা মেটাতে আমার একান্ত নিজের একটি থ্রি-ব্যান্ড রেডিওর খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ল কিন্তু তা কথায় পাবো? আমার সাথে সাথে বন্ধুরাও তখন টেস্টক্রিকেটে বেশ অভিজ্ঞ। তখন সীমিত ওভারের ক্রিকেট তেমন হতো না। আমরা কোন খোলা মাঠে গোল হয়ে বসে এক সঙ্গে খেলা শুনি। কখনো কখনো বা কোন বন্ধুর বাসার ছাদে রেডিও নিয়ে বসি। আমাদের কেউ কেউ বেশ সুন্দর ধৈর্য সহকারে সেন্টার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলা ধরতে পারতো।
অনেক সময় ইথারে ভেসে আসা রানিং কমেন্ট্রি ফ্রিকুয়েন্সির অভাবে একেবারে ক্ষীণ হয়ে যেত। তখন কেউ একজন রেডিওর একেবারে সাথে কান লাগিয়ে কোনক্রনে তা ধরে ধরে আবার আমাদেরকে একটু বাদে বাদে জানিয়ে দিত। সে ছক্কা বলে লাফ দিলে আমরাও তাঁর সাথে লাফিয়ে উঠতাম তারপর প্রবল উত্তেজনায় সবাই একসঙ্গে ঠেলাঠেলি করে মাথা গুঁজে দিতাম রেডিওর দিকে। বিপক্ষের কোন স্টার ব্যাটসম্যান আউট হলে তো কথাই ছিল না। আউট!! আউট!!সমবেত চিৎকারে ঘর একেবারে ফেটে যেত।
অন্য কোন ঝামেলা হলো কি না? জানতে এদিক ওদিক থেকে আতঙ্কিতরা দৌঁড়ে আসতো কাছে। খেলোয়াড়দের লাঞ্চের সময় আমরাও নানা রকম খওয়া দাওয়া করতাম তাছাড়া চানাচুর মুড়িতো সব সময় থাকতোই।
নিয়মিত খেলা শোনা কয়েকজন ক্রিকেট পাগলের কথাও বেশ মনে আছে। তোফাভাই তাঁদের মধ্যে একজন। পাকিস্তান হারুক বা জিতুক ভালো বা মন্দ যাই খেলুক ওর কাছে তারাই সেরা। একবার শহর ছেড়ে অনেক দূরে নিবিড় পল্লীতে আমরা যাচ্ছি কোন একটা পুকুরে হুইল বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে উঁচু রাস্তার ওপাশে গভীর অরণ্যের ভিতর থেকে ভেসে এলো ক্রিকেটের রানিং কমেন্ট্রি। এই সকালে বনের মধ্যে ক্রিকেট শোনে কে? কৌতুহল আর চেপে রাখতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে আস্তে আস্তে কমেন্ট্রি আরও স্পষ্ট হতে লাগল এবং একটু বাদেই ওপাশে থেকে বড় একটি রেডিও ঘাড়ে মাটির রাস্তায় উঠে এলো তোফা ভাই।
সেও হঠাৎ আমাদের দেখেই এক চিৎকার “ওস্তাদের মার শেষ রাতে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে”। বুড়ো মানুষের দাঁতের মত একের পর এক ঝড়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানেরা। ইমরান আর ওয়াসিমের আউট সুয়িং ইন সুয়িং এর কাছে একেবারে দাঁড়াতেই পারছেনা কেউ। স্লিপে একের পর এক ক্যাচ তুলে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে প্যাভিলিয়নে। তোফাভাই একটু বাদেই আবার চিৎকার দিল “খালি আসে আর যায়, বোলিং বোলিং, বাঘের বাচ্চা, বাঘের বাচ্চা, দিজ ইজ পাকিস্তান, জ্ঞানের খেলা, জ্ঞানের খেলা।” কাছে এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিল “খেলা শোন বাবু, খেলা শোন।”
তোফাভাই এই গ্রামে এসেছে ওর এক বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে কিন্তু সঙ্গে রেডিও আনতে ভুলেনি। আমরা তারসাথে যোগ দিয়ে মাটির রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলে মিলে বেশ অনেক্ষন সুদূর সিডনীর সবুজ চত্বর থেকে ভেসে আসা টেস্ট ক্রিকেটের সেই ইংলিশ কমেন্ট্রি শুনলাম।
এইরূপ যত্রতত্র একটু আধটু খেলা শুনে আমার পোষাচ্ছিল না। বরং একান্ত মনে নিরিবিলি খেলা শুনতে আমার নিজের একটি রেডিও খুব দরকার হয়ে পড়ল। আমার ব্যাপারটি বুঝে একদিন নানাবাড়ীতে বেড়াতে গেলে ক্রিকেটের তৃষ্ণা মেটাতে ছোট মামা নানার পরিত্যক্ত ভাঙ্গা থ্রি-ব্যান্ড রেডিওটি কাঠের বাক্স থেকে বের করে আমাকে দিয়ে দিল। নাপিতের বাক্সের মত লম্বা একটা এন.ই.সি রেডিও। মামা বলল “ঠিক করে নিস।”
উপরে কোন হ্যান্ডেল নেই, নবগুলি এক দুটো কোনক্রমে আছে বাকীগুলি নানাবাড়ীর বাচ্চাকাচ্চাদের উৎপাতে কোথায় যেন উড়ে গেছে। পিছনের ঢাকনা টান দিলে ভিতরের সব নাড়ীভূড়ি দেখা যায়। মিটার স্কেলের দাগগুলি স্থানে স্থানে অস্পষ্ট। ওর জানের ওপর দিয়ে যে বারবার তুফান বয়ে গেছে তা এক নজর দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এক সময় এটাই ছিল নানার বড় সাধের সম্পদ। অনেক দূর দূরান্ত থেকে লোকজন বাড়ীতে আসতো এর গান শুনতে। একাত্তরের যুদ্ধের সময় খবর শুনতে গ্রামের লোকেরা রাতে হারিকেন হাতে বাড়ীর উঠানে এসে জড়ো হতো। একটা জলচৌকির উপর তখন স্বযত্নে বসানো থাকতো রেডিওটি। নানী একটা নীল কাপড়ের কভার বানিয়ে দিয়েছিল রেডিওটিতে, সামনে সেন্টার দেখার জন্য মশারীর নেট, বাকি জায়গাগুলো টিপ বোতাম দিয়ে আটকানো।
নানা নিজেও খুব যত্ন করতো রেডিওটির ---- বৃদ্ধ বয়সে তিন বেলা খবর শুনে শুনে কাটত তার সময়। চারটে ব্যাটারি ছিল ওটার। রেডিও বন্ধ করার পরে ব্যাটারীগুলো খুলে মাটিতে পেতে রাখা হতো যাতে চার্জ চলে না যায়। আমি নানার কোল থেকে নেমে পেছনের ছিদ্র দিয়ে চোখ ছোট করে চেয়ে দেখতাম ভেতরে গান গায় কে? চোখ পরতো ছোট ছোট মানুষের মত অনেক কিছু দাঁড়িয়ে আছে আর পাশেই সোফার মত একটি চেয়ার। বলা হতো ওখানে বসেই না কী শিল্পীরা গান গায়।
যাই হোক সে তো গেল রেডিওটির ভরা যৌবনের কথা কিন্তু আমার হাতে যখন সেটা এলো তখন তার বৃদ্ধ বয়স। নিতান্তই এখন তার দরকার অবসর, তার দরকার একটু বিশ্রাম। নানা থেকে নাতি আর কত দিবে সে আমাদের ? পারলে ও যেন আমাকে স্বপ্নে দেখায় আমাকে ছাড়, নিস্তার দে, আমাকে মুক্তি দে – না হয় তোদের ক্ষতি হবে।
কিন্তু কে শুনে কার কথা। সে বৃদ্ধ অবসাদগ্রস্ত জেনেও রেডিওটি হাতে করে যখন মেকানিকের কাছে গেলাম – মেকানিক মুচকী হেসে বললো “এ ভালোমত সারানোর চেয়ে নতুন একটা কিনলেই বরং তারচেয়ে খরচ অনেক কম পড়বে এর মধ্যে কিচ্ছু নাই এ বাড়ী নিয়ে যান, খামাখা আমার সময় নষ্ট।” তবুও সে বারবার আমার প্রবল অনুরোধে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত হাত দিলো এবং কয়েক জায়গায় ঝালাই টালাই করে কোন রকমে বাজানোর একটা ব্যবস্থা করে দিলো।
আমি বাড়ী এনে মাথাভাঙ্গা এরিয়ালটি চিমটি দিয়ে টেনে তুলে দুই নারিকেল গাছে তার বেঁধে এনে এরিয়ালে পেঁচিয়ে দিলাম যাতে ফ্রিকুয়েন্সি বেড়ে যায়। প্লাষ্টিকের নবগুলি মুচড়ে মুচড়ে কেটে ভিতরে ভিতরে একেবারে প্যাঁচ কাটা। শত চেষ্টা করে কাগজ এটে দিলেও থাকতে চায়তো না। শেষে খাঁজ কাটা বাড়তি লোহার ফাঁড়া মাথার মধ্যে স্ক্রু ড্রাইভার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভলিয়ম বাড়াতে কমাতে হয়।
তবুও সেই বয়সে একান্ত নিজের একটি থ্রি-ব্যান্ড রেডিও থাকায় আমার বেশ গর্ব হতো। বন্ধুদের বাড়ী যখন তখন আর যেতে হয় না। অনেক রাত পর্যন্ত অল-ইন্ডিয়া ধরে সুন্দর সুন্দর গানশুনি। লতা, আশা, সন্ধ্যা, কিশোর, মান্নাদে, ভূপেন হাজারিকা এইরূপ আরও কত নামকরা শিল্পী। মাঝে মাঝে বি.বি.সি, ভয়েজ অব আমেরিকা আর ক্রিকেটের সময় তো কথাই নেই, ভোর থেকে অস্ট্রেলিয়া, অনেক রাত পর্যন্ত ইংল্যান্ড আর সারা রাত ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তখন চোখে মাঠ দেখতে পেতাম না, প্লেয়ার দেখতে পেতাম না। শুধু কানে শুনে শুনে গভীর কল্পনায় মনের মাঠে ডুবে যেতাম। সিডনী, মেলবর্ন, লর্ডসের সবুজ চত্বর--- মাঠের পাশে সারিবদ্ধ পামট্রি, সকালের নরম রোদ পড়ে গাঢ় সবুজ পাতাগুলো বাতাসে ঝিলমিল করছে। প্যাভিলিয়ন প্রান্ত থেকে সুঠাম দেহে সাদা ধবধবে পোষাকে বল নিয়ে ঝড়ো গতিতে দৌঁড়ে আসছে বলার। ওপাশে শক্ত হাতে ব্যাট উঁচিয়ে বাউন্ডারি হাঁকাবে বলে তৈরী চৌকস ব্যাটসম্যান। পরিকল্পিত ভাবে মাঠ সাজানো – দুটো স্লিপ, গালি, মিড-অফ, মিড-অন, এক্সট্রাকভার, লং লেগ, লং অন, থার্ড ম্যান। মাঠ ভর্তি দর্শক তার সাথে মুহুমুহু করতালী।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের জর্জ টাউন, এন্টিগুয়া, ত্রিনিদাদের সূর্যফাঁটা কড়কড়ে বলিং পিচ। ঝিমকালো দীর্ঘ দেহী কলারবোর্ণ জাগা পাকানো শরীরে একেবারে লাইন থেকে বড় বড় পা ফেলে ফেলে ছুটে আসা ক্যারিবিয়ান বলার। কড়কড়া হাতে ফাঁটা পিচে বল ঠুকে দিতেই তা বাউন্স করে উঠে এলো ব্যাটসম্যানের মুখ বরাবর। না খেলবে, না মুখ বাঁচাবে ভাবতে ভাবতে ব্যাটের কোনায় লেগে স্লিপে ক্যাচ।
ভারতের কথা আবার ভিন্ন। কাঠের গ্যালারিতে কানায় কানায় দর্শক ভর্তি। স্পিন সহায়ক পিচ। পাগড়ী পরা স্পিনার নাচতে নাচতে এসে কবজির মুচড়ে লাটিমের মত ঘুরিয়ে বল ছেড়ে দিল পিচে। ব্যাটসম্যান কিছু বুঝে উঠার আগেই হয় তা ছিটকে এসে উইকেট ভেঙ্গে দিলো, না হয় ব্যাটের হ্যান্ডেলে লেগে লাফিয়ে উঠলো উপরে অর্থাৎ মিডঅনে বা মিডঅফে সহজে ক্যাচ। আর ক্রিজ ছেড়ে ডাউন দ্যা উইকেট খেলতে গেলে তো কথাই নেই, লাইন মিস করলেই দক্ষ কিপার ক্ষিপ্র হস্তে উইকেট ভেঙ্গে দিল।
রেডিওতে কমিন্ট্রি শুনে সব কিছু মনের মত কল্পনা করে নিতে অন্য ধরনের এক মজা, অন্য ধরনের এক আমেজ। যা মাঝে মাঝে লাইভ ক্রিকেট দেখার চাইতেও উপভোগ্য আর আনন্দময় মনে হতো।
রেডিওটি আমার অনেক স্মরণীয় খেলার সাক্ষী। ভারতের সেই কপিলদেবের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয়। ম্যাগডরমেটের বলিং দাপটে নিজের মাটিতে কাপ জয়ের আশাভঙ্গ হয়ে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পাকিস্থানের দুঃখজনক পরাজয়। সারজায় ভারত পাকিস্থানের সেই ওয়ানডে – এক বল বাকী, পাকিস্থানের জাভেদ মিয়ানদাদের হাতে ব্যাট। ভারতীয় ফিল্ডাররা সব লাইনে কোনক্রমেই যেন চার না হয়। চার হলে কিন্তু জেতা ম্যাচ চলে যাবে ওদের হাতে। কিন্তু বলার বল ছুড়তেই ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে বল মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিল মিয়ানদাদ। পাখীর মত বল উড়ে গিয়ে ছক্কা।
ইডেনের মাঠে শেষ দিকে ব্যাটিং অর্ডার পল্টে ওয়াসিমকে নামিয়ে এনে নেহেরু কাপ জয় করে নিল ইমরান। তাছাড়াও কতবার ফলোঅন এরিয়ে শেষ পপর্যন্ত টেস্ট জয়। কয়েকটি খেলা একেবারে সমান সমান স্কোরে টাঁই এবং উল্লেখযোগ্য কয়েকজন বলালের হ্যাট্রিক বিশেষভাবে মনে থাকবে।
এইভাবে ক্রিকেট ইতিহাসের অনেক স্বরণীয় খেলা অনেক স্বরণীয় মুহূর্ত এই রেডিওতে আমার নিজ কানে শোনা। তাই ও ছিল আমার এক পরম বন্ধু ও শৈশব কৈশরের একাকীত্বের সাথী আর তার সাথে দীর্ঘকালের এক সুখসঙ্গ। ওর কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারিনা। আমার স্মৃতিতে তাই বার বার ওর ছবি ভেসে ওঠে। ওকে নিয়ে খুঁটিনাটি অনেক কথা মনে পড়ে। এখন আমার পাশে বিনোদনের অনেক কিছুই আছে কিন্তু ও নেই।
সেট-আপ নষ্ট হবে বলে ওকে সব সময় একটু উঁচুতে একটা তাকের উপর বসিয়ে রাখা হতো। ফলে প্রায়ই টিকটিকির ডিম পাওয়া যেত ভিতরে। মাঝে মাঝেই বুড়ো মানুষের মত নানা সমস্যাও দেখা দিত তার। আজ এটা, কাল ওটা, পরের দিন আরেকটা। একে তো পয়সার অভাব তারপর কত আর মেকানিকের কাছে নেওয়া যায়। মাঝে মাঝে ওর বেখেয়ালীপনা বুঝে উঠতে পারতাম না। ইচ্ছে হলে চলতো না হয় মন মর্জি বন্ধ থাকত, যেন কারো কোন কথা শোনার নেই।
শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই ঘাটাঘাটি করতে করতে অনেকটা ওর মতিগতি বুঝে ফেললাম এবং নিজে এক সময় বেশ সারাতেও শিখে গেলাম। নানা রোগের নানা ব্যবস্থাও এরই মধ্যে আমার জানাও হয়ে গেল। ফরফর করলে টুকরো পাটখড়ির ঠেকনা দেওয়া কিংবা মোটা সুতোর টানা দিয়ে ভলিয়ম বেঁধে রাখা। কখনো কখনোবা কাগজ ভাঁজ করে গুঁজে দেওয়া।
আবার কখনো কখনো পট্ পট্ শব্দ করলে বা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে টোকা কিংবা থাপ্পর চড় ইত্যাদি।
মাঝে মাঝে লাল লাইট পোস্টের মত সরে সরে যাওয়া সেন্টার কাঁটাটা শত ঘুরালেও আর সরতে চাইতো না। আটকে থাকত কোন এক নির্দিষ্ট জায়গায় তারপর ক্রমাগত স্ববলে ঘুরাতে থাকলে কোন এক সময় আবার কট্ করে ছুটে চলে যেত আকাঙ্ক্ষিত স্থান থেকে অনেক দূরে। তখন কোন নির্দিষ্ট সেন্টার ধরা খুব কঠিন হয়ে যেত।
তবে আমার দৌলতে কোন না কোনভাবে ওকে বেজে যেতেই হতো তার জন্য ওর কোন ক্ষমা ছিলনা, ওর কোন নিস্তার ছিল না। বৃদ্ধ বয়সে অবসাদের সময় এইরূপ নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্বেও তাকে আমার প্রয়োজনে, আমার বিনোদনে কাজ করে যেতেই হতো। সার্ভিজে কমতি পড়লে বয়োবৃদ্ধ হয়েও ওকে প্রাই আমার হাতে চড়-থাপ্পড় খেতে হতো।
তবে একদিন আমার এই নিষ্ঠুর আচরনের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ওর গায়ে শেষ পর্যন্ত অনেকক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন আমি নিজেকে ধিক্কার দিয়ে ভিতরে ভিতরে খুব মর্মাহতও হয়েছিলাম। সে দিন কাজটা ঠিক হয় নাই। সেদিন দোষ ছিল আমার। অন্যায়টা আমিই করেছিলাম। তার জন্য আজও আমি অনুতপ্ত।
শীতের সকাল, ঘরে বসে চা খেতে খেতে একমনে খেলা শুনছি। ইডেন উদ্যানে ভারত পাকিস্তানের ওয়ানডে ম্যাচ। চরম উত্তেজনা যাচ্ছে মাঠে। সেয়ানে সেয়ানে খলা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। নানাভাবে ফিল্ডিং সাজিয়ে বার বার বলিং ধারায় পরিবর্তন করেও কোন কাজ হচ্ছে না। সেই ওপেন করতে আসা একজন ব্যাটস্ ম্যানকে কোনক্রমেই আর আউট করা যাচ্ছিল না। সে শক্ত হাতে ব্যাট ধরে একটি সাইড সেই প্রথম থেকেই একেবারে আগলে রেখেছে। পেস এটাক এবং স্পিন এটাক দুটোই তাঁর কাছে সমানতালে মার খাচ্ছে।
কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাকে আউট করা গেলে খেলার মোড় একেবারে নিশ্চিত পাল্টে যাবে। অর্থাৎ সেই বিপক্ষের একমাত্র মাথাব্যাথা। এরই মধ্যে হঠাৎ একটা লুজবলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে সে উপরে ক্যাচ তুলে দিল। এসে গেলো সুযোগ ধক্ করে উঠলো আমার বুক। এই ক্যাচটি হতে পারে খেলার টারনিং পয়েন্ট। বল তখন উপর থেকে নীচে পড়ছে কভার থেকে ছুটে আসা ফিল্ডার ক্যাচটি ধরতে পারবে কি পারবে না – আমার হার্টবিট বেড়ে গেল।
কমেন্ট্রি বক্স থেকে বারবার বলা হচ্ছে “দেখা যাক কী হয়, দেখা যাক কী হয়।” কিন্তু ঠিক এই সময় আমার নগাঢিলা রেডিওটা ধপ্ করে বন্ধ। রাগে বিরক্তিতে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো আমার। উত্তেজিত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে রেডিওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাড়াতাড়ি টক্ টক্ দুটো টোকা দিলাম। কাজ হলো না, তারপর একের পর এক থাপ্পড় চড় কিন্তু আজ তাতেও কোন কাজ হলো না।
এতোক্ষণে ওদিকে নিশ্চয়ই একটা কিছু হয়ে গেছে। না জানি ক্যাচটা ফেলে দিলো কিনা? আর সহ্য করতে পারলাম না। রাগে বিরক্তিতে এবার তুলে দিলাম একটা আছাড় – ইচ্ছে হলো একেবারে চুরমার করে দেই। আমার ধারনা মার খেয়ে খেয়ে ওর জান যায় যায় অবস্থা তাই হঠাৎ বুঝি সে স্বভাব অনুযায়ী আগের মত একা একাই ভালো হয়ে গেলো।
কিন্তু ইডেন উদ্যান থেকে ভেসে এলো অন্য কথা ---- স্টুডিওতে যান্ত্রিক গোলযোগের দরুন খেলার চলতি ধারাবিবরনী বন্ধ থাকায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
----------------
Wow apu...onk vlo likhsen.