বন্যাকে সেদিনি আমার প্রথম দেখা। দুপুরবেলা ডালিম গাছের ছায়ায় বসে আমার মেয়ে তুলতুলের সাথে ধুলোমাটিতে খেলা করছিল। আমার মেয়ের মতই ওর বয়সও চারপাঁচ হবে। দুজনেই খালি গা, পরনে হ্যাফপ্যান্ট, মাথায় বড় বড় চুল। ধুলোমাটিতে গা গতর মাখামাখি। দুপুরে অফিস ফেরা বাবাকে দেখে মেয়ে আমার ছুটে এলো কোলে। বন্যা তখন দূরে দাঁড়িয়ে কী এক বিষ্ময় নিয়ে স্থির চেয়েছিল আমার দিকে। আমার বাকপটু কন্যা কোলে চড়েই তার নতুন সাথীর সমুদয় পরিচয় বর্ণনা করল এক নিশ্বাসে।
বন্যা আমাদের বাড়িতে আসা নতুন কাজের লোকের মেয়ে। আমি বাড়ির দরজায় ঢুকতে ঢুকতে ওর দিকে শেষবারের মত দৃষ্টি ক্ষেপণ করলাম। শিশুটি ডাগর দুটো গভীর নয়নে দলচ্যুত হরিণ শাবকেরমত তখনও আমার দিকে চাওয়া। বন্যা প্রথম প্রথম আমার কাছে ভিড়ত না। ওর মধ্যে ছিল যথেষ্ট ভয় আর সংশয়। তবে আমি ওকে অবাধ করার চেষ্টা করতাম। যাতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আর ওর মা অনেকদিন থেকে যায় আমাদের বাড়িতে।
আজকাল বাসাবাড়িতে কাজের লোকের বড়ই অভাব। তাই সঙ্গে বাচ্চা থাকা সত্বেও কারো কারো ঘোর আপত্তি উপেক্ষা করে বন্যার মাকে আমরা কাজে নিয়েছিলাম। বন্যাদের অবস্থা এক সময় মোটামুটি ভালোই ছিল। ওর বাবার বাজারে একটা ছোট খাটো ফলের দোকান ছিল। কিন্তু তড়িঘড়ি ধনী হতে সব গুঁটিয়ে সে দালাল ধরে সমুদ্রপথে বিদেশ রওনা দিল। শেষ পর্যন্ত বিদেশের দেখা কিন্তু তার মিলে নাই। যাত্রা পথে মাঝ সমুদ্রেই আরও কয়েক জনেরমতই তারও হলো সলিল সমাধি। তারপর থেকেই বন্যাদের কপালে এই দুর্যোগের ঘনঘটা। এই অপরিসীম দুর্ভোগ এবং সাথে সাথে জীবন যুদ্ধের এই কঠিন সূচনা।
প্রথম প্রথম সবাই আশ্বাস দিয়েছিল, এদেখবে ওদেখবে। কিন্তু পরে যার যার সংসার নিয়ে সেই সেই ব্যস্ত। তখন পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। এমন কি কাউকে খুঁজেও পাওয়া গেল না। কাজেকাজেই শিশু কন্যার আহার যোগাতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বন্যার মাকে বাসাবাড়িতে কাজ নিতে হল।
বন্যার মা গরিব হলেও ভালো বংশের মেয়ে। তার চলা ফেরা কথাবার্তা স্বভাব চরিত্র ভদ্র এবং মার্জিত। অল্প বয়সে বিধবা হয়েও শিশু কন্যার দিকে চেয়ে অনেকের প্রস্তাব থাকা সত্বেও নতুন করে আর ঘরও বাঁধেল নাই। সে কাজ শেষে অবসর পেলেই স্বামীর স্মৃতি আওড়াত। ওর স্বামী কেমন ছিল। দিন শেষে কেমন বাজার সদাই করে ঘরে ফিরত। বন্যাকে কেমন আদর করত। রথের মেলা থেকে মেয়ের জন্য কেমন খেলনা পুতুল কিনে আনত। বাপ বেটির কেমন মিল ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি।
বন্যার মায়ের এসব একটানা বর্ণনা বাড়ির মেয়েরা কেউ কতক্ষণ শুনত কেউবা ধৈর্যচ্যুত হয়ে সরে যেত এদিক সেদিক। আবার কেউবা মাঝ পথে কান্নারত বিধবাটিকে থামিয়ে ওকে ঠেলে দিত নতুন কোন ফুট ফরমায়েশে। কিছুদিন যেতে বন্যা তখন আমার সাথে অনেকটাই সাবলীল। তুলতুলের সাথে সেও এসে মাঝে মাঝে আমার কাছ ঘেষে দাঁড়ায়। অনেক সময় আপন মনে এটা ওটা নাড়া চাড়া করত। আমার স্ত্রী তাতে খুব আপত্তি জানাত। বন্যার মা তখন দৌড়ে এসে ওর হাত থেকে জিনিষপত্র ছাড়িয়ে ওকে তুলে নিয়ে যেত রান্না ঘরে আর বন্যার শুরু হতো একটানা বিরামহীন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না।
তুলতুলের মায়ের ভয়ে বন্যা সাধারনত আমাদের বড় ঘরে আসতে চাইত না। তবে আমি ওকে একটু আধটু লাই দিতাম বলে আমি একা থাকলে ও নির্দ্বিধায় ঢুকে যেত। তুলতুলের সাথে ওর তেমন বড় কোন বিরোধ ছিল না। তুলতুল বিস্কুট চানাচুর কিছু খাওয়ার সময় ওকে অল্প স্বল্প ভাগ দিত। তুলতুলের পুরাতন জামা কাপড়গুলো সাধারনত জুটত বন্যার কপালে। আমিও চাইতাম আমার ছোট্ট মেয়েটা একটা সঙ্গ পাক। কারণ শিশুদের মনের বিকাশ সমবয়সীদের সাথেই বেশী ঘটে।
আমি তাই তুলতুলের সাথে বন্যাকে দেখলে নিজের
মেয়ের পাশাপাশি ওকেও একটু আদর করে দিতাম। বন্যার মা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে খুব খুশি হতো । বন্যার নিজেরও বাবার কথা কিছু কিছু মনেছিল। বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে ও খেলনা পুতুলের স্মৃতিময় গল্প সামান্য সামান্য বলতে চেষ্টা করত। বাবা বিদেশ থেকে পুতুল নিয়ে আসবে। লাল জামা নিয়ে আসবে, পাখী নিয়ে আসবে আরও কত কী ? ওর ধারনা বাবা ওর তখনও বেঁচে আছে। আমি যদি জানতে চাইতাম বাবা তোমাকে খুব আদর করত ? ও মাথা কাত করে বলত হুঁ। আমি জিজ্ঞেস করতাম তোমার বাবা কোথায় চলে গেছে ? ও আকাশের দিকে ছোট্ট আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখাত -- ঐ বিদেশ।
আমি এক দিন মোড়া পেতে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে বই পড়ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে বন্যা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল -- মামা পাগল, পাগল। আমি ধরফড়িয়ে উঠে দেখলাম একটা উসকো খুসকো চুলের ভিক্ষুক থালা হাতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বন্যা তখনও আমাকে জড়িয়ে কাপঁছে। আমি ওকে অভয় দিয়ে বললাম -- ও পাগল না, পাগল না, ও ভিক্ষুক। ভয় নাই, তোমাকে কিছু বলবে না। কিন্তু ভয়ে সিটিয়ে সে তখনও আমাকে ছাড়ছিল না। ভাগ্যিস ওর মা তখন তুলতুলকে নিয়ে সেখানে হাজির।
যাই হোক এই ভাবেই কাজের মেয়ের সরল শিশুটি অনেকটা আমাদের পরিবারভুক্ত হয়েই লালিত হচ্ছিল। আমরা জানতাম ও আমাদের কাজের লোকের মেয়ে। কিন্তু ওর সেই বৈষম্যের ধারনা তখনও তৈরী হয় নাই। ওর ভাবনা, তুলতুলেরমত সে নিজেও এ বাড়িতে আরেকজন। তারও বুঝি এখানে তুলতুলের মতই সমধিকার। যদিও চটপটে সরল শিশুটি তার অনধিকার চর্চা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে কারো কারো দ্বারা হোঁচট খেত। কিন্তু পরক্ষণেই তা আবার ভুলে গিয়ে চঞ্চল কাঠবিড়ালীরমত সেই একি ভুলেরই পূনরাবৃত্তি ঘটাতো।
আমাদের বাড়িতে পর্যায়ক্রমে দিন অতিক্রান্তের সাথে সাথে সবার সঙ্গে আপন হয়ে যাওয়ার মানষিকতাও তার উত্তর উত্তর পূর্ণতা লাভ করছিল। বন্যা কখনো আমাকে একা পেলেই অধীর আগ্রহে বাবার গল্প শোনাতে চাইত। অথবা আমার পাশ দিয়ে অকারনে ঘুর ঘুর করে ওর প্রতি আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করত। তুলতুলের সাথে মিছেমিছি রান্নাবাড়ি খেলার সময় আমি সামনে পড়ে গেলে ফিক করে হেসে দিত। পেয়ারা গাছের মাটি ছুঁই ছুঁই বাঁকা ডালের দুলুনীতে আপন মনে ঘোড়ায় চড়ি, ঘোড়ায় চড়ি, খেলার সময় কাছে গিয়ে দাঁড়ালে কী এক লজ্জায় সবুজ পাতার আবডালে হাসতে হাসতে মুখ লুকাত। এই ভাবেই চলছিল জীবন প্রবাহের সবকিছু ঠিকঠাক।
কিন্তু কয়েকদিন বাদে দেখা গেল হঠাৎ বন্যার মা কিছুদিনের জন্য অনুপস্থিত। এরপর সপ্তাহ দুয়েক বাদে আবার যখন অসুস্থ বন্যাকে কোলে করে কাজে এলো, তখন উপকার পেয়ে পেয়ে অভ্যস্তরা তাঁকে হঠাৎ না পাওয়াতে অনেক গালমন্দ করল। তবে উত্তর উত্তর জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল বন্যা হঠাৎ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। এমন কী ডাক্তাররা চিন্তিত হয়ে ওর জীবনাবসানের আশঙ্কা পর্যন্ত করছে। তাদের পরামর্শ কাল বিলম্ব না করে সত্বর বন্যাকে শহরের কোন বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হউক।
কিন্তু অর্থসংকটে অসহায় বন্যার মা এই জরুরী পদক্ষেপেও অপারগ। এক নজরেই বন্যার তখন বেহাল দশা। সেই চঞ্চলতা আর নেই। সেই উৎফুল্লতা ফিকে হয়ে গেছে। জীর্নশীর্ন ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে শিশুটি সারাক্ষণ কী এক জড়তায় স্থবিরতায় নিস্তজে বসে থাকে উঠানের কোনে। বাড়ির লোকজনেরও এখন ওর প্রতি নজর কম। তারা ওকে দেখেও না দেখার ভান করে। যেন কী বা করার আছে ? তখন সবার সাথে তাল মিলিয়ে আমিও আনেকটা উদাসীন। তবে সেই সময়কার একটি ছোট্ট ঘটনা আজও আমাকে বিশেষভাবে পীড়া দেয়।
সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। চারিদিকে উৎসবের আমেজ। আমার ছোট্ট মেয়ে তুলতুলকে ওর মা সখ করে শাড়ি পরিয়ে, কপালে টিপ আর পায়ে আলতা দিয়ে বৈশাখী সাজে সাজিয়ে ছিল। পহেরা বৈশাখে মেয়ের এই রূপ দেখে আমিও ভিষণ আপ্লুত। বিকেলে বৈশাখীর মেলার পাশ দিয়ে সাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে, মেয়ের কথা মনে করে ওর জন্য একটা বউপুতুল কিনে ব্যাগে ভরে নিলাম। এরপর বাইসাইকেল চালিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে পড়ন্ত বিকেলে যখন বাড়ি ফিরলাম, তুলতুল তখন বন্যাকে নিয়ে বাড়ির সামনে নির্জন উঠানে এসে দাঁড়ানো।
আমি সাইকেল থামিয়ে স্মিত হেসে ব্যাগের বউপুতুলটা তুলে মেয়ের হাতে দিলাম। পুতুলটা বুকে জড়িয়ে তুলতুল তখন মহা খুশিতে আত্মহারা। মেয়ের আনন্দে আমিও কিছুটা চনমনে কিন্তু পরক্ষণেই পাশে দাঁড়ানো বন্যার মলিন মুখের দিকে চেয়ে আমি একটা হোঁচট খেলাম। বন্যা মনদিয়ে পুতুলটা দেখছে এবং কতক্ষণ পর্যবেক্ষণ শেষে ধীরে ধীরে মাথা তুলে আমার দিকে করুণ চাইল--- মামা, আমার জন্য একটা আনেন নাই ?
আমি তাৎক্ষনাৎ সেই বিবেকবর্জিত কান্ডের কোন সদ্উত্তর দিতে পারি নাই। কিন্তু আজও আমি নিজকে ধিক্কার দিয়ে সেই অপরাধবোধে বারংবার জর্জরিত। কয় টাকাই বা দাম ছিল একটা মাটির পুতুলের। কি বা ক্ষতি হতো আরেকটা পুতুল রুগ্ন অনাথ শিশুটির জন্য কিনে আনলে ? কিন্তু আমি তা তুচ্ছ জ্ঞানে এড়িয়ে গেছি।
আমার মেয়ে তুলতুল বড় হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে। পিতৃহীন গুরুতর অসুস্থ বন্যা মেয়েটির শেষ পর্যন্ত কী পরিনতি হয়েছিল, আমি আজও জানি না। কারন ওরা কদিন বাদেই আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর কোনদিন আসে নাই। কিন্তু সেই আফসোস, সেই লজ্জাবোধ, সেই আক্ষেপ, আজও আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়।
সেই ক্ষিণ কন্ঠের সরল জিজ্ঞাসা আজও বারংবার আমার কানে প্রতিধ্বনিত হয়--- মামা, আমার জন্য একটা আনেন নাই, আমার জন্য একটা ?
........
Very nice article.... very informative article. Thank you.