২০ টাকার গল্প
--------------------------
আমি তখন চাকরির ৩ বছর গ্রামে কাটিয়ে মেডিকেল কলেজে এনেসথেসিয়া তে জয়েন করেছি । পেরিফেরিতে টিসি , পিসি লেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম , সে তুলনায় মেডিকেলের এনেসথেসিয়ার লাইফটা ছিল চার্মফুল । বৈচিত্র ছিল বেশ । কেউ পেট ফুটো করে আসছে , কেউ মাথা ফাটিয়ে আসছে , কেউ অবস্ট্রাকশন নিয়ে আসছে ... খারাপ রোগী এনেসথেসিয়া দিতে আমার ভালোই লাগতো , তবে লেবার ওটি তে ভালো লাগতো না ... কারন এ ওটি তে চিল্লাচিল্লি বেশি , ওটিও হতো বিরামহীন । সার্জন দের স্ট্রেস থাকতো আমাদের থেকে বেশি । ভাইয়া ... ফিটাল ডিসট্রেস ... ভাইয়া ব্লিডিং ...ভাইয়া রক্ত কালো লাগে... ভাইয়া রাপচার ... ভাইয়া কনট্রাক করেনা ... এরকম নানান সমস্যা । গাইনির সিএ দের যেমন নিঃশ্বাস নেবার সময় নেই আমাদের তেমনি দম ফালানোর সময় থাকে না । আমি খুব চেষ্টা করতাম লেবার ওটি এড়িয়ে চলতে ।
এ লেবার ওটি তেই তাঁকে একদিন দেখেছিলাম । চেয়ারে চুপচাপ বসে ছিল ... প্রথম দেখাতে প্রেম আসলে সিনেমা বা গল্প সাহিত্যে হয় ... বাস্তবে সেটি হয় না বিশেষ করে ওটির ভিতর , তবে মেয়েটি কে ভালো লেগেছিল । বাচ্চা বাচ্চা , স্নিগ্ধ , মায়াময় চেহারা ... খুব সম্ভব থার্ড ইয়ারের প্লেসমেন্ট বা ইন্টার্ন হবে । তবে , ওটির ব্যস্ততায় একটু পর তাঁকে আর খুঁজে পেলাম না । এরপরও দু একবার মেয়েটি কে দেখেছি , তবে কথা বলা হয় নি । মেডিকেল লাইফে কোনদিন প্রেমে পড়িনি , অবশ্য প্রেম করার যে সাহস লাগে সেটা আমার কোন দিনই ছিল না , চিন্তা করলাম এবার সাহস করে মেয়েটিকে বলেই ফেলবো । কিন্তু সে অপরূপার দেখা আর পাই না , তাঁর কোন নামও জানি না , কাউকে বলতেও পারছিনা। এদিকে রোসটারে দেখি মাত্র ২ দিন লেবারে ডিউটি ... ঈশ , স্যার কেন আমাকে ৭ দিন লেবারে ডিউটি দেয় না !! রাত্রে ঘুম আসে না , মনের কষ্টে আমার বনে যাবার অবস্থা ।
এরকম সময়ে একদিন সকাল বেলা আমার এক কলিগ ফোন দিল । সেদিন আমার অফ ডে ছিল , বিছানায় শুয়ে শুয়ে মান্না দের গান শুনছিলাম ...
-- হ্যালো ভাই , আমি একটু ঝামেলায় পড়েছি , আপনি কি একটু কষ্ট করে আমার লেবার ওটির ডিউটি টা করতে পারবেন ??
আমি খুশীতে আত্নহারা হয়ে বললাম ... অবশ্যই , অবশ্যই !!
-- পরে আমি আপনার একটা ডিউটি করে দিব ...
--আচ্ছা ( মনে মনে বললাম , না করলেও সমস্যা নাই ) ।
দৌড়াতে দৌড়াতে হাসপাতালে ছুটলাম । রিকশা থেকে নেমে দেখি , অতিরিক্ত উত্তেজনায় আমি মানিব্যাগ ফেলেই চলে এসেছি । অন্য দিন আশেপাশে পরিচিত মানুষের অভাব হয় না , আজ যেহেতু বিপদে তাই দেখি আশেপাশে কেউ নেই । ঠিক তখনি দেখি যার জন্য দৌড়াচ্ছি সেই বাচ্চা সুন্দরি মেয়েটি এপ্রোন পড়ে আমার দিকেই আসছে ।
নিটল পায়ে রিনিকঝিনিক পায়েল খানি বাঝে ,
মাদল বাজে , সেই সংকেতে শ্যামা মেয়ে নাচে ।
আমারো ইচ্ছা করছে নাচতে , তবে আমার অবস্থান গত কারনে সেটা সম্ভব না । এই প্রথম তাঁকে থামালাম
-- এই যে শোন ...( মেয়েটি কম করে হলেও আমার থেকে ৭-৮ বছরের ছোট , স্টুডেন্ট বা ইন্টার্ন হবে , তুমি করে বলতেই পারি )
মেয়েটি থামলো , তাঁর ঠোঠে হালকা হাসি ।
--বিশ টা টাকা হবে , ভুলে মানিব্যাগ ফেলে এসেছি ।
মেয়েটি এবার মুচকি হাসল ... কোন কথা না বলে বিশ টাকা বের করে দিল
--আমি পরে তোমাকে টাকা টা দিয়ে দিব , তোমার তো গাইনি তে প্লেসমেন্ট , তাই না।
এবার সে হো হো করে হেসে উঠলো । বাঁধ ভাঙা হাসি । যেন রবিশঙ্করের সেতার... যেন প্রভাত জেগে উঠা পূর্ব গগনে সূর্যের মিষ্টি আভা । মনে মনে বললাম , হাসছো কেন তুমি ... বাস্তবে বলা হল না, কারন বিশ্রী একটা ফোন ... ভাইয়া রাপচার উটেরাস , তাড়াতাড়ি আসেন
ভগ্ন হৃদয়ে ওটিতে আসলাম । খারাপ রোগী , ভয়াভহ রাপচার ... আরএস আসলো ... সেও সুবিধা করতে পারছে না... বলল , মেডাম কে ফোন দাও ।
একটু পর দেখি , সেই মেয়েটি ওটি তে এসেছে ... আহারে! আজ আমার কি ভাগ্য... আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসলো ...
-- ভালো আছেন ??
এই প্রথম আমার সাথে কথা বললো
--জি জি খুব ভালো
এমন সময়ে বেরসিক আরএস এর বিকট চিৎকার , মেডাম তাড়াতাড়ি আসেন , হিসট্রেকটোমি লাগবে ...
--আসছি , ওয়াশ নিচ্ছি
অধিক শোকে মানুষ পাথর হয় , আমি কংক্রিট হয়ে গেলাম । খাইছে , এ মেডাম নাকি!!!
মেয়েটি এবার পরিচয় দিল ।আমি এসিটেন্ট প্রফেসর ......। নামটা আর শোনা হল না ... কানে আর কিছুই ঢুকলো না
--সরি , মেডাম , আমি আপনাকে চিনতে পারিনি । ইন্টার্ন ভেবেছি
-- সমস্যা নাই ... এরকম আমি আগেও ফেস করেছি ।
মনে মনে নিজেকে গালি দিলাম । ভাগ্যিস ঘটনা বেশী দূর যায়নি ... ২০ টাকা তে এসে থেমে গেছে । এরপর আর কি ... মাঝে মাঝে ওটি তে কল দেন ... আগের মতোই আগ্রহ নিয়ে যাই । ২০ টাকা আর দেওয়া হয় নি ... টাকার কথা বললেই আবার সেই বাধভাঙ্গা হাসি । আমিও আর চেষ্টা করি না ... কিছু কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকতেও ভালো লাগে ... বিশ টাকাই তো ............