একটি ফুলের গল্প
বাইরে যেতে হবে বলে সকাল সকাল গোসল সেরে নিলেন নাজমা চৌধুরী। বয়স হয়েছে তাই আজকাল বেশির ভাগ সময় ঘরেই কাটান তিনি। তবে মাঝে মাঝে মনটা বাইরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। সারাজীবন বাইরে কাজ করেছেন, ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। আজ চরম বার্ধক্যে একা ঘরে বসে বই পড়ে সময় কাটাতে হয়। বাইরে যান মাঝে মাঝে কোনো ফুলের দোকানে, কখনো কোনো আত্মীয়ের বাসায় কিংবা কোনো শপিংমলে দরিদ্র শিশুদের জন্য জামা কাপড় কিনতে। নাজমা চৌধুরী বৃদ্ধা হলেও এখনো বেশ স্মার্ট। তার চলাফেরা এবং পোশাক নির্বাচন খুব সুন্দর, মানানসই। দেখলেই বোঝা যায় তিনি একজন সুরুচিশীলা এবং একসময় খুব সুন্দরী ছিলেন। আজ তিনি হালকা আকাশি রঙের শাড়ি আর ফুলহাতা কালো ব্লাউজ পরেছেন। ছোটখাটো একটি কালো চাদর ফেলে রেখেছেন গায়ের ওপর। কালো ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে গেটের বাইরে পা দিলেন তিনি। সামনে তাকাতেই দেখতে পেলেন একটি ফুটফুটে কিশোরী। তাকিয়ে রইলেন আনমনে। মেয়েটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল ফুল কিনবেন ম্যাডাম?
মুচকি হাসলেন নাজমা চৌধুরী। বললেন দাও দেখি একটি গোলাপ।
লাল টকটকে তরতাজা গোলাপটি বেশ বড়। ভেজা ভেজা। দেখে মনে হচ্ছে ভোরের কুয়াশার আদরমাখা ছোয়া লেগে আছে ফুলটিতে। মুগ্ধ হয়ে দেখলেন নাজমা চৌধুরী। মেয়েটির আগোছাল চুলের ঢিলেঢালা খোঁপায় পরিয়ে দিলেন গোলাপটি। খোঁপার এক পাশে রাখা গোলাপটি কিশোরীর মুখ আরো উজ্জ্বল করে তুলল। নাজমা চৌধুরী খুশিতে বলে উঠলেন বাহ্ খুব সুন্দর মানিয়েছে। তোমার নামটি তো জানা হলো না।
মেয়েটি অবাক হলেও হেসেই উত্তর দিলো আমার নাম ফুলভানু। তয় সক্কলে আমারে ফুল বইলাই ডাকে।
খুব সুন্দর। যেমন তুমি তেমন তোমার নাম। সত্যিই তুমি একটি ফুল।
ম্যাডাম আপনে ফুল কিনলেন আবার আমারেই দিয়া দিলেন ব্যাপারটা কী ?
ফুলটি আমি তোমার জন্যই কিনেছি। তোমার হাতে কত ফুল কিন্তু তোমার অত সুন্দর মুখের পাশে খোঁপায় ফুল নেই। আচ্ছা আমি এখন যাই। তুমি এখানে এসো মাঝে মাঝে।
নাজমা চৌধুরী গাড়িতে উঠলেন। ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে ভাবলÑ ম্যাডামের মাথায় মনে অয় গণ্ডগোল আছে। মাথার আর কী দোষ। এই বয়সে নিজের আপন কেউ যদি কাছে না থাকে মন মেজাজও তো ভালো থাকে না। তয় আমাগো ম্যাডাম খুব ভালো মানুষ। কোনো দিন কোনো কারণেও চইটা কথা কয় না।
ফুল নাজমা চৌধুরীর গাড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মনে মনে বলল এমন মানুষও আছে। আমার ফুল আমার মাথায় গুঁইজা দেয় আবার ফুলের দামও দেয়। কি জানি পাগল মনে অয়। আসলে বড় লোকেগোতো ঢংয়ের অভাব নাই। ট্যাকা পয়সার চিন্তা নাই খাওনের চিন্তা নাই। যা করবার মন চায় তাই করে। তয় মানুষটা তো ভালোই মনে অইল।
নাজমা চৌধুরী গাড়িতে বসে ভাবেÑ এখন আর ফুলের জন্য বসন্তের অপেক্ষা করতে হয় না। সারা বছরই ফুল পাওয়া যায়। মাত্র বসন্তের শুরু তাই ফুলের দোকানগুলোতে কেমন তাজা ফুলের সমারোহ। এখন ফুল ব্যবসার পণ্য হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এখন ফুল লোকদের ফ্যাশনের বস্তু হয়ে উঠেছে। তবে ক’জনইবা ভালোবাসে ফুলকে। অনুষ্ঠান শেষ হলেই সব ফুল চলে যায় ডাস্টবিনে। বড় অপচয় হয় ফুলের। এসব কথা ভাবতে ভাবতে চোখে ভেসে ওঠে তার হারিয়ে যাওয়া ফুলের বাগান। গাছ লতা পাতা ভরা সুখের নীড়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির ছাত্রী ছিলেন তিনি। ছাত্রী বয়সেই বউ হয়ে এসেছিলেন গুলশানের একটি শান্ত ছায়াঘেরা বাড়িতে। বেশ বড় এড়িয়া নিয়ে বানানো হয়েছিল সেই টিনশেড বাড়িটা। একতলা সেই বাড়ির পেছনে ছিল বড় বড় আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি ফলের গাছ। সামনে বিশাল বারান্দা আর বারান্দার সামনেই ছিল সুুদীর্ঘ ফুলের বাগান। শাশুড়ি রুমেনা চৌধুরী ছিলেন নাজমা চৌধরীর খুব প্রিয় মানুষ। রুমেনা চৌধুরী ছিলেন শিক্ষিতা ভদ্র একজন রুচিশীলা ভালো মানুষ। তারই উদ্যোগে বাড়িটা ভরে উঠেছিল গাছ লতা পাতায় আর ফুলে ফলে। বেশ বড় সেই বাড়িটার খানিকটা দূরে দূরে ছিল বকুল, কাঠ মালতি, গন্ধরাজ এ ধরনের বড় বড় গাছ। বাগানের ভেতরে ছিল শতাধিক দেশী বিদেশী ফুলের গাছ। ফুলের মওসুমে বাগানের দিকে তাকালে মনে হতো লাল নীল গোলাপি খয়েরি কমলা হলদে নানা রঙের মিশ্রণে ভরা একটি সুন্দর ছাপার শাড়ি মেলে রাখা হয়েছে।
বাগানের মূল পরিচর্যা করতেন রুমেনা চৌধুরী নিজেই। তাকে সাহায্য করত জমির আলী। একজন বয়স্ক লোক জমির আলী। সারাক্ষণ বাড়ির গাছপালা ফুলের বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত। গাছের পরিচর্যার জন্য তাকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।
রুমেনা চৌধুরী তার ব্যবসায়ী ছেলের জন্য নাজমা চৌধুরীকে নিজেই পছন্দ করে ঘরে তুলে ছিলেন। তবে তিনি জানতেন না যে তার বউ ও একজন ফুলের প্রিয়াসী। এক কথায় ফুল ও ফল গাছপালার প্রেমে পাগল পাড়া। ধীরে ধীরে রুমেনা চৌধুরী বুঝতে পারেন তার বউমার ফুল অনুরাগের ব্যাপারটি। একদিন নাজমা চৌধুরী বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে বাতাসে ফুলের দোলা দেখে আনমনে হাসছিলেন। ব্যাপারটি তার শাশুড়ির চোখ এড়ায়নি। খুশিতে রুমেনা চৌধুরী বউকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। বললেন, এবার আমার উত্তরসূরি পেয়ে গেছি। এই ফুলের বাগান, কোনায় কোনায় হাজারী গোলাপের ঝোপ, সন্ধ্যা মালতির ঝোপ, দোলন চাঁপার ঝোপ আর বড় বড় ফুল গাছগুলো সব তোমার। আজ থেকে তুমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওদের দেখাশোনা করবে।
নাজমা চৌধুরী শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই এ বাড়ি দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। মনে মনে বলেছিলেন, এমন একটি বাড়ি আমি পেলাম যে বাড়িটা আমার স্বপ্ন ছিল। তবে আমি কোনো দিন ভাবিনি স্বপ্নের বাড়িটা একদিন বাস্তবে রূপ নেবে। সে দিন শাশুড়ির কথায় তিনি নিজেকে এই স্বপ্নপুরীর রানী ভেবেছিলেন। তাই তিনি উল্লাসে বলে উঠেছিলেন এই ফুলে ফুলে ভরা সোনার স্বপ্নপুরীটা আমার।
ছেলের বউয়ের আবেগ দেখে সে দিন রুমেনা চৌধুরীও তার নিজের আবেগ ভরা চোখের পানি লুকিয়ে রাখতে পারেননি।
এক আত্মীয়ের বাসায় সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন নাজমা চৌধুরী। গাড়ি থেকে নেমেই দেখতে পেলেন সেই মেয়েটা, সকালে যার সাথে দেখা হয়েছিল। হাতে কোনো ফুল নেই। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পিঠের উপরে পড়ে আছে। ওর মুখের দিকে ভালোভাবে তাকালেন তিনি। দেখতে পেলেন দু’চোখে জলের ধারা। লাইট পোস্টের আলোতে তার জলেভরা মুখটি চকচক করছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে মা? কাঁদছ কেন? এই সন্ধ্যাবেলায় এখানে কেন বসে আছ ? কথা বল মা। তুমি তো