স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে-
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে।
কে পরিবে পায়?
সত্যিই তাই মুক্ত জীবনের প্রশান্তি সকলের কাম্য। জন্মভূমির বুকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার মত প্রশান্তি বিরল। প্যালেস্টাইনের এক কবি বলেছেন-
“স্বদেশের মাটি স্পর্শ করার সময় ছাড়া আমার শির আর কখনও নত হয় না।” কবির এ উচ্চারণে ফুটে উঠেছে স্বদেশের জন্য ভালােবাসা, গভীর অনুভূতি। মূলত দেশপ্রেম এক সহজাত অনুভব । প্রতিটি মানুষের অন্তরে এ অনুভব উজ্জ্বল আলাের মতাে জেগে থাকে। দেশের প্রতি যার ভালোবাসা নেই, তার অপরাধ ক্ষমার অযােগ্য। দেশের মাটি মায়ের মতাে। সেজন্যই দেশকে বলা হয় দেশমাতা। আমরা দেশমাতার কোলে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠি। দেশের আলাে – জল, মাটির স্পর্শে আমাদের তনু- মন পুষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস স্বদেশের কাছে ঋণী। আমাদের অনুভবের প্রতিটি সীমানায় স্বদেশের পতাকা, আমাদের জীবন আমাদের স্বদেশেরই দান।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। এ সমাজ আবার কতকগুলাে ধর্ম, ভাষা, নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভৌগােলিক সীমায় বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে স্বতন্ত্র বা পৃথক রাষ্ট্র, জাতি বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে থাকে। এ স্বাতন্ত্র্যবােধ তীব্র হয়ে যখন অঞ্চল বিশেষের মানুষের মধ্যে একটি ঐক্য চেতনা জাগিয়ে তোলে, তখনই তার নাম হয় দেশাত্মবােধ, স্বজাত্যবোধ বা স্বদেশপ্রেম । স্বদেশের ভৌগােলিক সীমা, তার অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, তার ভাষা , প্ৰাকৃতিক সম্পদ, এমনকি ধর্মবােধ এসব নিয়েই স্বদেশপ্রেমকে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এ স্বদেশকে আপনার বলে জানা, স্বদেশের মানুষ, প্রানি, মৃত্তিকা সব কিছুর জন্য মমত্ববোধ সংস্কৃতিবা মানুষের একটি মৌলিক বৃত্তি । এ বৃত্তিকেই আমরা বলি স্বদেশপ্রেম। এছাড়া দেশের কোন বিপদে দেশকে রক্ষার জন্য ব্যক্তি স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের জন্য নিজেকে সমার্পন করা।ভিন্ন দেশের নিকট নিজ দেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতি কে তুলে ধরা।ও বিশ্বের নিকট দেশকে মর্যাদা সম্পন্ন করে তোলাকেই এক কথা স্বদেশ প্রেম বলা হয়।
একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে তার দেশের জনগণের উপর।যদি দেশের নাগরিক এর ভির নিজের দেশের প্রতি ভালবাসা না থাকে তাহলে সে দেশ কখনো উন্নতি সাধন করে না।একটি দেশকে অগ্রযাত্রার পথে ধাপিত করে স্বদেশ প্রেম।স্বদেশ প্রেম একটি মানুষকে দেশের প্রতি আত্ন ত্যাগ করায় উৎসাহিত করে।যদি কোন ব্যাক্তি তার দেশের প্রতি নিজেকে ঋনী না মনে করেন তাহলে তার সেই দেশের নাগরিক ও সে দেশের একজন সন্তান দাবি করাই বৃথা।কারন প্রতিটি মানুষের তার দেশের প্রতি সীমাহীন ঋন রয়েছে। আর তা কখনোই শোধ হবার নয়।দেশকে ভিন্ন দেশের নিকট মহিমান্বিত করে তোলার জন্য একমাত্র উপায় হলো স্বদেশে প্রেম।এ কারনেই স্বদেশ প্রেমের গুরুত্ব অপরিসীম।
জননী এবং জন্মভূমি আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয়া জননী জন্মদাত্রী স্তন্যে-স্নেহে আমাদের লালন- পালন করে। আর জন্মভূমি আমাদের সবাইকে শস্যে ফলে অন্নে পানীয়ে পুষ্ট করে তােলে। তাই সে আমাদের জননী। কবি গেয়ে ওঠেন, “তুমি মুখে তুলে দিলে, তুমি শীতল জলে জুড়াইলে, তুমি যে সকল সহা সকল বহা মাতার মাতা।” তাই জননীর কাছে আমাদের যেমন অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে অনুরুপ জন্মভূমির প্রতিও আমাদের সকলের অনেক দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে।
যুগে যুগে দেশ প্রেমিকগণ জগতের ইতিহাসে তাদের কর্মময় জীবনের মহান দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কল্যাণে তাদের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, লেনিন, মাওসেতুং, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন মেন্ডেলা , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা দেশকে ভালােবেসে দীর্ঘকাল কারা বরণ করেছেন। অত্যাচার আর পীড়ন সহ্য করেছেন এবং দেশ ও জাতির মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করেছেন। কোনাে ভয়, প্রলােভন তাদেরকে কাবু করতে পারেনি। শত বিপর্যয়ের মুখেও তারা দেশ মাতৃকার মুক্তি ব্রত থেকে পিছু হটেননি। তাইতাে বিশ্বের ইতিহাসে এসব মহান দেশপ্রেমিকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।
প্রতিটি দেশের মানুষের ভিতরই কিছু না কিছু স্বদেশ প্রেমের দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়। এবং অনেক জাতির ক্ষেত্রে তা ত্যাগের চরম শিখরে পৌঁছে গেছে।বাঙ্গালি জাতির কথা চিন্তা করলেই আমরা তা বুঝতে পারি। বাঙ্গালী ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য প্রান দিয়েছে।এরপরে ১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন বলী দিয়েছেন।যাদের আত্ম ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি।এরুপ অনেক মানুষ আছেন যাদের অনেকের নাম ইতিহাসের পাতায় আছে। আবার অনেকের নাম ইতিহাসের পাতায় ঠাই পায়নি। অগোচরে রয়ে গিয়েছে তাদের আত্মত্যাগ।
দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এদেশের জনগণ মায়ের মতাে দেশমাতৃকার প্রতি ভালােবাসা প্রদর্শন করেছে। ৫২, ৫৪, ৬৬, ৬৯ সালে রক্ত দিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত হয়ে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে এদেশ, এ মাটিকে শত্রু মুক্ত করেছে শধু স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়েছিল বলে। দেশ সৃষ্টির এরুপ দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। তবে বাংলাদেশে স্বদেশ প্রেমের নামে মাঝে মধ্যে উগ্র দেশপ্রেমের নজিরও দেখতে পাওয়া যায়। এক শ্রেণির মানুষ দেশপ্রেমের নামে সাধারণ মানুষকে ধােকা দিয়ে স্বার্থ হাসিল করে।
দেশপ্রেম শুধু ইতিহাস, ঐতিহ্য, মনীষীদের বাণী বা ধর্মীয় বিধানেই সীমা বদ্ধ নয়। বাংলা কাব্যে দেশের প্রতি অগাধ ভালােবাসার সমূহ ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। সতেরাে শতকের কবি আব্দুল হাকিম তার নূরনামা’ কাব্যে বঙ্গবাণী’ কবিতায় দেশের প্রতি গভীর উপলদ্ধি ও বিশ্বাসের কথা নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন। তিনি যাদের স্বদেশের প্রতি অনীহা তাদের ধিক্কার দিয়েছেন, “যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী। সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।” অর্থাৎ বঙ্গ বিদ্বেষীদের জন্ম পরিচয় নিয়ে তিনি সন্দেহ পােষণ করেছেন। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্বপ্নময়, স্মৃতিময় এদেশের রূপে বিমােহিত হয়ে গেয়েছেন,
“ধনধান্যে পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।”
কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলাদেশকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালােবেসে রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে গেয়েছেন,
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,
তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।”
প্রকৃত দেশপ্রেমিক ব্যক্তি কখনও সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেন না। নিজের দেশকে ভালােবাসা মানে অন্য দেশের প্রতি শত্রুতা নয়। যে দেশপ্রেম শুধু নিজের দেশের জন্য সে দেশপ্রেম অন্ধ এবং পক্ষপাতদুষ্ট। “স্বদেশ আমার ভূমি, কিন্তু বিশ্বও আমার পর নয়” এটাই প্রকৃত দেশপ্রেমের বাণী। কাজেই নিজের দেশকে ভালােবাসতে হবে আবার সমগ্র বিশ্বের প্রতিও সহমর্মিতা জাগ্রত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রকৃত দেশপ্রেম নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখে না বরং বৃহৎ পৃথিবীর মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়।
কবি গেয়েছেন, “ও আমার দেশের মাটি তােমার পরে ঠেকাই মাথা।” প্রতিদিন ভাের বেলা যে আলাে, আকাশ, মৃত্তিকা, বায় আর মানুষের সাথে আমাদের দেখা, সে তাে আমাদেরই স্বদেশ। দেশকে ভালােবেসে আমরা আমাদের জন্মঋণ শােধ করতে পারি । সুতরাং, প্রেমের গভীর অনুভূতি বুকে ধারণ করে আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হােক-
“এই দেশেতেই জন্ম
যেন এই দেশেতেই মরি।”