যাদের সাথে বিয়ে হারাম

0 7
Avatar for Alsha
Written by
4 years ago

যাদের সাথে বিয়ে হারাম

আমরা মুসলিম। কুরআন আমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা । যাতে লিপিবদ্ধ রয়েছে মানুষের সব করনীয় তথা হালাল-হারাম, উচিত-অনুচিতসহ সব বিধি-বিধান। অবৈধ নারীকে অথবা অবৈধ নিয়মে বিবাহ করে সংসার করলে ব্যভিচার করা হয়। এমন কতকগুলি কারণ রয়েছে যার কারণে নারী-পুরুষের আপোসে কোন সময়ে বিবাহ বৈধ নয়। নিচে কারণগুলো আলোচনা করা হলঃ

প্রথম কারণ, রক্তের সম্পর্কঃ

নারী-পুরুষের মাঝে রক্তের সম্পর্ক থাকলে যেহেতু এক অপরের অংশ গণ্য হয় তাই তাদের আপোসে বিবাহ হারাম। এরা হল;

১- পুরুষের পক্ষে; তার মা, দাদী, নানী এবং নারীর পক্ষে; তার বাপ, দাদো ও নানা।

২- পুরুষের পক্ষে; তার কন্যা (বেটী) এবং নাতিন ও পুতিন, আর নারীর পক্ষে; তার পুত্র (ছেলে) এবং নাতি ও পোতা।

৩- পুরুষের পক্ষে; তার (সহোদরা, বৈপিত্রেয়ী ও বৈমাত্রেয়ী) বোন, বুনঝি, ভাইঝি ও তাদের মেয়ে, ভাইপো ও বুনপোর মেয়ে। আর নারীর পক্ষে; তার (সহোদর, বৈপিত্রেয় বা বৈমাত্রেয়) ভাই, ভাইপো, বুনপো ও তাদের ছেলে এবং ভাইঝি ও বুনঝির ছেলে।

৪- পুরুষের পক্ষে; তার ফুফু (বাপের সহোদরা, বৈপিত্রেয়ী বা বৈমাত্রেয়ী বোন) এবং নারীর পক্ষে; তার চাচা (বাপের সহোদর, বৈপিত্রেয় বা বৈমাত্রেয় ভা­ই)।

৫- পুরুষের পক্ষে; তার খালা (মায়ের সহোদরা, বৈপিত্রেয়ী বা বৈমাত্রেয়ী বোন) এবং নারীর পক্ষে; তার মামা (মায়ের সহোদর, বৈপিত্রেয় বা বৈমাত্রেয় ভাই)।

প্রকাশ যে, সৎ মায়ের বোন (সৎ খালা) পুরুষের জন্য এবং সৎ মায়ের ভাই (সৎ মামা) নারীর জন্য হারাম বা মাহরাম নয়। এদের আপোসে বিবাহ বৈধ।

৬- পুরুষের পক্ষে; তার বাপ-মায়ের খালা বা ফুফু এবং নারীর পক্ষে তার বাপ-মায়ের চাচা বা মামা অবৈধ।[2]

প্রকাশ যে, পুরুষের জন্য তার খালাতো, ফুফাতো, মামাতো, চাচাতো বোন ও (তাদের মেয়ে) বুনঝি বৈধ ও গম্য। অনুরূপ নারীর জন্য তার খালাতো, ফুফাতো, মামাতো, চাচাতো ভাই ও ভাইপো বৈধ ও গম্য।

আবার পুরুষের পক্ষে; তার (মামার মৃত্যু বা তালাকের পর) মামী, (চাচার মৃত্যু বা তালাকের পর) চাচী এবং নারীর পক্ষে তার (খালার মৃত্যু বা তালাকের পর) খালু (ফুফুর মৃত্যু বা তালাকের পর) ফোফা গম্য। পূর্বোক্ত গম্য-গম্যার মাঝে বিবাহ বৈধ ও পর্দা ওয়াজেব।

রক্তের সম্পর্ক যদি কৃত্রিম হয়, তবে বিবাহ হারাম নয়। সুতরাং (রোগিনীকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে তাকে বিবাহ করা রক্তদাতা পুরুষের জন্য অবৈধ নয়। অনুরূপ স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে রক্ত দান করলে বিবাহের কোন ক্ষতি হয় না।[3]

দ্বিতীয় কারণঃ বৈবাহিক সম্পর্ক :

১- পুরুষের জন্য (স্ত্রী ও শবশুরের মৃত্যু বা তালাকের পরেও) শাশুড়ী, নানশাশ ও দাদশাশ। (স্ত্রীর সাথে মিলন না হলেও) চিরতরে হারাম। অনুরূপ নারীর পক্ষে তার শবশুর, দাদোশবশুর ও নানাশবশুর অগম্য।

২- রমিতা (যার সাথে সঙ্গম হয়েছে এমন) স্ত্রীর (অপর স্বামীর) কন্যা ও তার বংশজাত কন্যা ও পুতিন বা নাতিন। (স্ত্রীর সাথে মিলন হলে তবে। নচেৎ মিলনের পূর্বে মারা গেলে বা তালাক দিলে তার মেয়ে অবৈধ বা অগম্যা নয়।) তদনুরূপ নারীর জন্য তার স্বামীর (অপর স্ত্রীর) ছেলে ও তার বংশজাত ছেলেও অবৈধ।

৩- পুরুষের জন্য তার সৎমা (বাপ তার সাথে মিলন করুক অথবা না করুক। বাপ মারা গেলে বা তালাক দিলেও) হারাম। অনুরূপ সৎ দাদী এবং নানীও।

নারীর জন্য তার সৎবাপ (মায়ের সাথে তার মিলন হলে) অগম্য। অনুরূপ সৎ দাদো এবং নানাও হারাম।

৪- পুরুষের জন্য তার নিজের পুত্রবধূ (আপন ঔরসজাত ছেলের স্ত্রী) অনুরূপ পুতবউ ও নাতবউ এবং নারীর জন্য তার নিজের গর্ভজাত কন্যার স্বামী (জামাই) অনুরূপ নাতজামাই ও পুতজামাই অবৈধ।

সুতরাং পুরুষের জন্য তার সৎশাশুড়ী, স্ত্রীর দুধমা, (বিতর্কিত) এবং পালয়িত্রী মা হারাম নয়। অনুরূপ নারীর জন্য তার সৎশ্বশুর, স্বামীর দুধবাপ (বিতর্কিত) এবং পালয়িতা বাপ অবৈধ নয়।

স্বামীর এক স্ত্রীর ছেলে-মেয়ের সাথে দ্বিতীয়া স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত ছেলে-মেয়ের বিবাহ বৈধ।[4]

প্রকাশ যে, বৈবাহিক সূত্রে মিলনের ফলে যাদের সাথে বিবাহ অবৈধ, ব্যভিচার সূত্রে মিলনের ফলে তাদের সাথে বিবাহ অবৈধ কি না--তা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। অর্থাৎ যেমন বিবাহের পূর্বে কোন নারীর সাথে ব্যভিচার করলে তার মা বা মেয়েকে বিবাহ করা হারাম হবে কি না এবং বিবাহের পরে ব্যভিচার করলে ঐ নারীর মা বা মেয়ে (যে এই পুরুষের স্ত্রী) তার পক্ষে হারাম হয়ে যাবে কি না, শবশুর-বউ-এ ব্যভিচার করলে ছেলের উপর তার ঐ স্ত্রী হারাম হয়ে যাবে কি না, ব্যভিচারজাত কন্যাকে বিবাহ করা যাবে কি না, -এসব বিষয়ে বড্ড মতভেদ রয়েছে। অবশ্য কোন পক্ষের নিকটেই সহীহ কোন দলীল নেই। যদিও অনুমান, অভিরুচি ও বিবেকমতে হারাম সাব্যস্ত হওয়াই উচিৎ।[5]

পরন্তু বহু উলামা বলেন, কারো সাথে ব্যভিচার করলেই সে স্ত্রী এবং তার মা শাশুড়ী হয়ে যায় না। সুতরাং এতে ব্যভিচারের কোন প্রভাব নেই।[6] নৈতিক শৈথিল্যের এমন অশ্লীলতা, পশুত্ব ও সমস্যা থেকে আল্লাহ মুসলিম সমাজকে মুক্ত ও পবিত্র রাখুন। আমীন। পক্ষান্তরে বৈধরূপে স্ত্রী মনে করে সহবাস করলে সম্পর্কে প্রভাব পড়ে। যেমন; বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধ না হয়েই সহবাস করলে অথবা সহবাস করার পর জানা গেল যে, ঐ স্ত্রীর সাথে স্বামীও কোন দুধ-মায়ের দুধ পান করেছে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী হারাম সাব্যস্ত হবে এবং তার মা ও মেয়েকে বিবাহ করা ঐ পুরুষের জন্য হারাম হবে।[7]

তৃতীয় কারণঃ দুধের সম্পর্ক :

যদি কোন শিশু (ছেলে অথবা মেয়ে) কোন ভিন্ন মহিলার দুধ পান করে থাকে, তবে সে তার দুধমা। অবশ্য ‘দুধমা’ সাব্যস্তের জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে;

১। ঐ দুধপান শিশুর ২বছর বয়সের ভিতরে হতে হবে। দু’বছর পার হয়ে দুধপান করলে ‘মা’ সাব্যস্ত হবে না।[8]

২। তৃপ্তিসহকারে পাঁচ অথবা ততোধিক বার দুধপান করবে।[9] স্তনবৃন্ত চুষে অথবা মাইপোষ, চামচ কিংবা নলের সাহায্যে দুধ পেটে গেলে তবেই ‘মা’ সাব্যস্ত হবে।[10]

‘দুধমা’ সাব্যস্ত হলে তার সাথে এবং রক্ত-সম্পর্কীয় অন্যান্য আত্মীয়র ন্যায় ঐ মায়ের বংশের সকলের সাথে বিবাহ অবৈধ হবে।[11]

সুতরাং রীতিমত দুধপানকারী পুরুষ তার দুধ-মা, দুধ-বোন, দুধ-খালা, দুধ-ভাইঝি, দুধ-বোনঝি প্রভৃতিকে চিরদিনের জন্য বিবাহ করতে পারবে না। তদনুরূপ দুধপানকারী মহিলার তার দুধ-বাপ, দুধ-ভাই, দুধ-চাচা, দুধ-মামা, দুধ-ভাইপো, দুধ-বুনপো প্রভৃতির সাথে বিবাহ বৈধ নয়।
অবশ্য যে দুধ পান করেছে তার অন্য ভাই-বোনেরা ঐ মায়ের পক্ষে এবং তার ছেলেমেয়ে বা অন্যান্য আত্মীয়র পক্ষে হারাম নয়।[12]
কোন পুরুষ যদি (শিশুবেলায়) তার দাদীর দুধ রীতিমত পান করে থাকে, তবে তার পক্ষে রক্ত-সম্পর্কীয় মহিলা ছাড়াও চাচাতো, ফুফাতো এবং নানীর দুধ পান করে থাকলে মামাতো খালাতো বোনও হারাম। কারণ, এই বোনেরা তখন দুধ-ভাইঝি ও দুধ-বোনঝিতে পরিগণিত হয়ে যায়।[13]
উল্লেখ্য যে, শৃঙ্গারের সময় স্ত্রীর দুধ মুখে গেলে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ-বন্ধনে কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, এটা রীতিমত দুধ পান নয়।

চতুর্থ কারণঃ লিআন :

স্বামীর সংসারে থেকে যদি স্ত্রী ব্যভিচার ক’রে তা অস্বীকার করে এবং এই ব্যভিচারের উপর যদি স্বামী ৪ জন সাক্ষী কাজীর সামনে উপস্থিত না করতে পারে, তবে কাজী প্রত্যেককে কসম করাবেন; প্রথমে স্বামী বলবে, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, আমি আমার স্ত্রী অমুককে যে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছি তাতে সত্যবাদী।’ এইরূপ চারবার বলার পর পঞ্চমবারে তাকে থামিয়ে কাজী বলবেন, ‘আল্লাহকে ভয় কর, এই (শেষ কসম)টাই আল্লাহর আযাব অনিবার্যকারী। (সত্য বল। কারণ,) আখেরাতের আযাব হতে দুনিয়ার আযাব (মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার শাস্তি) সহজতর।’ এরপরেও যদি সে বিরত না হয়, তবে পঞ্চমবারে বলবে, ‘আমি আমার স্ত্রী অমুককে যে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছি, তাতে যদি আমি মিথ্যাবাদী হই তাহলে আমার উপর আল্লাহর অভিশাপ হোক!’ অতঃপর স্ত্রী অনুরূপ বলবে, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি যে, আমাকে আমার স্বামী অমুক যে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছে তাতে ও মিথ্যাবাদী।’ এইরূপ চারবার বলার পর পঞ্চমবারে থামিয়ে কাজী তাকে বলবেন, আল্লাহকে ভয় কর, এটাই আল্লাহর আযাব অনিবার্যকারী, (সত্য বল। কারণ,) আখেরাতের আযাবের চেয়ে দুনিয়ার আযাব (ব্যভিচারের শাস্তি) সহজতর।’ এরপরেও যদি বিরত না হয়, তাহলে পঞ্চমবারে সে বলবে, ‘আমাকে আমার স্বামী অমুক যে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছে, তাতে যদি ও সত্যবাদী হয়, তাহলে আমার উপর আল্লাহর গযব হোক!’ এতদূর করার পর কাজী স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ করে দেবেন। আর এতে কারো শাস্তি হবে না।[14]

এই ধরনের লা’নত ও অভিশাপের বিচ্ছেদকে ‘লিআন’ বলে। এই বিচ্ছেদ হওয়ার পর ঐ স্ত্রী ঐ স্বামীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যায়। কোন প্রকারে আর পুনর্বিবাহ বৈধ নয়।[15] প্রকাশ যে, রক্ত, দুধ ও বৈবাহিক সম্পর্কের ফলে যাদের আপোসে চিরতরে বিবাহ অবৈধ কেবল তাদের সামনেই মহিলার পর্দা নেই। বাকী বন্ধুত্ব, পাতানো, বা পীর ধরার (?) ফলে কেউ হারাম হয় না। সুতরাং বন্ধুর বোন, পাতানো বোন এবং পীর-বোনের (?) সাথেও বিবাহ হালাল এবং পর্দা ওয়াজেব।

রেফারেন্সঃ

[1] (সূরা আন-নিসা (৪) : ২৩)

[2] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৯/৭৩)

[3] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৩/৩৭০, ৪/৩৩২)

[4] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ২/২৬২, ৯/৬৭)

[5] (সিলসিলা যয়ীফাহ ১/৫৬৬, ইখতিয়ারাত ইবনে তাইমিয়্যাহ ৫৮৫-৫৮৮পৃঃ, ফাতাওয়া মুহাম্মদ বিন ইব্রাহীম ১০/১৩০)

[6] (মুমঃ ৭/৪৪)

[7] (ঐ ৭/৪৫)

[8] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২৩৩)

[9] (মুসলিম)

[10] (আহকামু খিতবাতিন নিকাহি ফিল ইসলাম, ডক্টর শওকত উলাইয়্যান)

[11] (বুখারী ৫০৯৯নং, মুসলিম)

[12] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৬/২৬৩)

[13] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ৬/২৬৬)

[14] (সূরা আন-নূর (২৪) : ৬-৯, বুখারী, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৩০৭নং)

[15] (আহকামু খিতবাতিন নিকাহি ফিল ইসলাম ১১৬পৃঃ)

1
$ 0.00
Avatar for Alsha
Written by
4 years ago

Comments