বার্সেলোনা সেভিলা কৌশলগত বিশ্লেষণ

0 3
Avatar for Alsha
Written by
3 years ago

গতকাল রাতে হয়ে গেলো লা লীগার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ম্যাচ। গতকালকের ম্যাচ ছিল ট্যাকটিক্স প্রেমীদের জন্য অসাধারণ একটা ম্যাচ। কোচের একটা মুভ তো প্রতিপক্ষ কোচের আরেকটা মুভ ম্যাচের গতিপথ বারবার পাল্টে দিচ্ছিল।

বার্সেলোনার নেমেছিল ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে,

নেতো

রবার্তো-আরাউহো-পিকে-আলবা

ফ্রাঙ্কি-বুশি

গ্রিজি-কুতিনহো-ফাতি

মেসি

আগের ম্যাচের চেয়ে এই ম্যাচে একটাই চেঞ্জ, রেড কার্ডেড লংলের জায়গায় আরাউহো।

সেভিয়া নেমেছিল ৪-৩-৩ ফর্মেশনে,

বোনো

নাভাস-কৌন্দে-কার্লোস-আকুনা

জর্দান-ফারনান্দো-রাকিটিচ

সুসো-লুক ডি ইয়ং-অকাম্পোস

ম্যাচ শুরুই হয়েছিল চমৎকার এক ইন্টেন্সিটির মাধ্যমে যা পুরো ৯০ মিনিট বর্তমান ছিল।

বার্সা কাল অন দা বলে বিল্ডাপের সময় ৩-১-৪-২/৩-১-৩-৩ এই ফর্মেশনে বিল্ডাপ করছিল যেখানে রবার্তো এবং আলবা দুজনই মিডফিল্ডে চলে এসে টাচলাইন হোল্ড করছিল। ফ্রাঙ্কি লেফট সিবি রোলে গিয়ে ৩ জনের ব্যাকলাইন করে বল ডিস্ট্রিবিউট করছিল আর ৩ জনের সামনে লোন ফিগার ছিল বুস্কেটস।

তবে কাল বেশিরভাগ সময়ই সেভিয়া বার্সার সিবিদের প্রেস করেছে। যার ফলে নেতো শর্ট পাসে বিল্ডাপ শুরু হওয়ার পর বার্সা ফ্রিভাবে বল সার্কুলেশন করতে পারছিল না। নিচ থেকে ফর্মেশন বিল্ড করে বল সাপ্লাই করার স্পেস সেভিয়া দিচ্ছিল না। সেভিয়ার প্রেসিং লিড দিচ্ছিল তাদের তিন এটাকার, জর্দান, রাকিটিচ। নাভাস ও একুনা বার্সার দুই উইংগার ফাতি এবং গ্রিজমানকে কড়া নজরে রাখছিল যেন তারা নিচে নেমে বিল্ডাপে অপশন না বাড়াতে পারে।

যেহেতু সেভিয়া তাদের ৭ জন আউটফিল্ড প্লেয়ার এক্টিভ প্রেসিংয়ে ব্যবহার করছিল তাই লং বল ছাড়া অপশন ছিল না। তবে কোন টার্গেট ম্যান যেহেতু নেই তাই লং বল দেওয়া হতো স্পেসে যেন গ্রিজি/ফাতি/কুতিনহো তাদের স্পিড কাজে লাগিয়ে বল রিসিভ করতে পারে। ফারনান্দো ম্যাচের প্রথম দিকে একটু এডভান্স রোলে থাকায় আরাউহো বা পিকের লং পাস সেভিয়ার প্রেস ব্রেক করতে পারছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ফারনান্দো কৌন্দে এবং কার্লোসের অনেক ক্লোজ চলে আসে যার কারণে পরবর্তীতে লং বলে সেকেন্ড বল উইন করাও আমাদের জন্য কঠিন হয়ে দাড়ায়।

লং বল সিস্টেমে কোন অপশন না পেলে উইং ধরে কম্বিনেশন প্লে এর মাধ্যমে বল প্রগ্রেশন এর চিন্তা করা হচ্ছিল। কারণ সেভিয়া গতকাল সেন্ট্রালি ফ্রাঙ্কি বা বুশিকে ডিরেক্ট কড়া মার্কিং এ না রাখলেও জোনাল মার্ক করছিল এবং ওদের পায়ে কোন এক সময় বল আসলেই আশে পাশে ২-৩ জন সবসময় প্রেসিং শুরু করে দিতো।

আবার একই সাথে উইং এরিয়াতে বল গেলে সেভিয়ার ৪-৫ জন উইং এরিয়া ওভারলোড করে পাসিং লেন ব্লক করে দিতো। ফলে বল প্রগ্রেশন সবসময় স্মুথ হয়নি।

অফ দা বলে বার্সা ৪-১-৪-১ এ মুভ করছিল যেখানে ডিফেন্সের সামনে লোন ফিগার ফ্রাঙ্কি। তবে বার্সা সেভিয়ার লোয়ার লাইনকে বল সার্কুলেট করতে দিচ্ছিল। তার কারণ বার্সার প্রধান লক্ষ্য ম্যান টু ম্যান প্রেসিং না করে পাসিং লেন ব্লক করা এবং উইং এরিয়াতে বল গেলেই নিউমিরিকাল এডভান্টেজ ক্রিয়েট করে বল উইন। অথবা বল পায়ে যারা অত ভালো না, বল মুভ করতে দেরি করে তাদের ২-৩ মিলে প্রেসিং করে বল উইন করা। গত দুই ম্যাচের মতো প্রত্যেকটা বলের পিছনে না ছুটে এই ম্যাচে অফ দা বলে কোম্যানের প্ল্যান ছিল ট্যাক্টিকালভাবে মোকাবেলা করা।

বার্সার এটাক কাল ছিল সেন্ট্রাল ভিত্তিক। গত দুই ম্যাচে যেখানে বেশিরভাগ বলই লেফট সাইডে গিয়েছে সেখানে কাল আমরা খেলেছি অনেক বেশি সেন্ট্রালি( আগের ম্যাচ দুটির তুলনায়)। লেফট সাইডে ফাতি-আলবা-কুতিনহো কম্বিনেশন সেভিয়া অফ করে দিচ্ছিল নিউমিরিকাল সুপেরিওরিটি ক্রিয়েট করে। রাইটে সুসো-নাভাস-জরদানের সাথে আরও একজন জয়েন করতেন ফলে লেফট সাইডে কম্বিনেশন এটাক করা সহজ ছিল না।

অন্যদিকে সেভিয়া অন দা বলে ছিল ৩-৪-৩ এ। নাভাস এবং আকুনা মিডে উইংব্যাক হিসেবে চলে যেতো। ফারনান্দো ডিফেন্সে এসে এক্সট্রা একজন সিবি হিসেবে কাজ করতো। যেহেতু ফারনান্দো ডেস্ট্রয়ার টাইপের প্লেয়ার তাই তাই তাদের লো প্লে মেকার ছিল না। নিচ থেকে বল সাপ্লাইয়ের জন্য তাই তাদের বড় অস্ত্র ছিল কৌন্দে-কারলোস এর লং বল৷ কৌন্দে বা কার্লোসের লং বল গুলো বেশিরভাগই ছিল নাভাস বা আকুনাকে কেন্দ্র করে। বার্সার ডিফেন্সের পেছনে স্পেস কাজে লাগানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সেই অপশন না থাকলে লুক ডি ইয়ং তো ছিলই।

উইং বেইজড এটাক, মাঠের যেকোন এরিয়ায় নিউমিরিকাল সুপেরিওরিটি, ফিজিকালিটি, ইন্টেনসিটি এবং সেকেন্ড বল উইন; এই ছিল সেভিয়ার খেলার স্টাইল মোটা দাগে। লেফট উইং এ আকুনা-অকাম্পোস-রাকিটিচ কিংবা রাইটে নাভাস-সুসো-জর্দানের মাধ্যমে বল বের করে বক্সে লং ক্রস, এই ছিল সেভিয়ার মূল গেম প্ল্যান।

অফ দা বলে সেভিয়া ছিল সবচেয়ে ইম্প্রেসিভ। বার্সার সেন্টারব্যাক বা মিডফিল্ড সেভিয়ার প্রেস ব্রেক করে ফেললে সেভিয়া ডিফেন্ড করতো কখনো ৫-৪-১ শেপে বা কখনো ৬-৪-০ শেপে। সেভিয়া জানতো বার্সার কোন টার্গেট ম্যান নাই, তাদের এটাক মুভমেন্ট ভিত্তিক। এজন্যই ৬ জনের ব্যাকলাইন ক্রিয়েট করতো তারা যেন ফাইনাল বল সাপ্লাই করার জন্য স্পেস বা মুভ করার মতো স্পেস বার্সা না পায়।

লিওনেল মেসিকে আটকানোর ও ইফেক্টিভ একটা ওয়ে এটা। যেহেতু মেসি রাইট সাইড থেকে ভেতরের দিকে আসে তাই ব্যাকলাইন থেকে একজন প্লেয়ার তাকে মার্ক করলেও সেভিয়ার ব্যাকলাইন ৫ জনের ই থাকছে। এতে করে খুব বেশি স্পেস ওপেন হচ্ছে না। কারণ মেসি নিজে শ্যুট না করলেও আরেকজনকে ফ্রি করে দেয় তার মুভমেন্ট দিয়ে। কিন্তু কাল সেভিয়ার এই ব্যাকলাইন তা করতে দেয় নি। উল্লেখ্য গতবছর রোমান সানচেজে ৫ জনের ব্যাকলাইন ক্রিয়েট করেই মেসিকে আটকে রেখেছিল সেভিয়া। যার নেতৃত্বে ছিল ফারনান্দো, গতকালও সেইম।

যেহেতু কোন মুভমেন্ট ছিল না বার্সার এটাকে তাই নিচ থেকে আরাউহো-পিকে-ফ্রাঙ্কি বুশি বা কুতিনহো/মেসি কেউই তেমন লাইন ব্রেকিং পাস দিতে পারে নি। বার্সার বল মুভিং ও ছিল তাই তুলনামূলক স্লো। অপশন ক্রিয়েট না হওয়ায় বল মুভমেন্টও তাই একঘেয়ে মনে হচ্ছিল অনেক সময়।

সেভিয়ার এই ডিফেন্সিভ স্ট্র‍্যাটেজির কারণে বার্সা খুব বেশি স্পেস পায়নি শট নেবার। একই সাথে লো ব্লক ডিফেন্স হওয়ায় ডিফেন্সের পেছনে ব্লাইন্ড রান নেয়ার মতো স্পেস ছিল না। আর আমাদের এটাকারও ব্লাইন্ড রান নেয়ার জন্য খুব বেশি পটু না।

তবে সেভিয়া হাইলাইনেই আসলেই তাদের পেছনে ব্লাইন্ড রান নিয়ে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। যা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয় বার্সা।

ম্যাচের শুরুতেই চরম কাউন্টার প্রেসিংয়ের মাধ্যমে কর্ণার জিতে নেয় সেভিয়া। সেখান থেকে মিসজাজ হেড থেকে বল পেয়ে গোল করেন লুক ডি ইয়ং। গোল কন্সিডের সাথে সাথেই মেসির লব পাসে আলবার ফ্রি রান আটকাতে গিয়ে ভুল করে বসেন নাভাস। কুতিনহোর সিম্পল ট্যাপ ইনে সমতায় আসে বার্সা।

এরপর দুই দলই খুব বেশি স্পষ্ট গোলের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলেও প্রেসিং-কাউন্টার প্রেসিং-লাইন ব্লক করে বল উইন বা নিউমিরিকাল এডভান্টেজে কাউন্টার এটাকে খেলা জমে উঠে। এই প্রেসিংয়ের কারণেই সেভিয়ার ভুলে ফার্স্ট হাফে বড় একটি সুযোগ পান গ্রিজমান যা তিনি মিস করেন।

সেকেন্ড হাফও যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই শুরু হয়৷ গ্রিজমান আরেকবার গোলকিপারকে একা পেলেও লুজ টাচে বল তার হাতে তুলে দেন। তবে সেভিয়ার ইন্টেনসিটি আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ৬০ মিনিটে সেভিয়ার দুই এটাকার তুলে (সুসো ও অকাম্পোস) মুনির, এল নাসেরি কে নামানো হয়৷ মাঠে তখনো লুক ডি ইয়ং ছিল। তিনজনই এয়ারে খুবই স্ট্রং। তবে এই সাবের কারণে সেভিয়ার সবচেয়ে বড় চেঞ্জ এসেছে প্রেসিং এ, যেন নতুন উদ্যম খুজে পায় সেভিয়া।

মিডফিল্ডে খুব টাফ ব্যাটেল চলতে থাকলেও স্পষ্ট গোলের সুযোগ খুব বেশি আসছিল না। বার্সার অন্যতম কি প্লেয়ার আলবা ইঞ্জুরিতে পড়ায় কোম্যান একটু ব্যাকফুটে পড়েন, এটাকিং চেঞ্জের বদলে একটা ডিফেন্সিভ চেঞ্জ করতে বাধ্য হন। তবে এই সুযোগেই অভিষেক হয় সার্জিনো ডেস্টের।

ম্যাচের ৭৮ মিনিটে রাকিটিচের বদলে গুদেলের সাব সেভিয়ার ডিফেন্সিভ স্ট্র‍্যাটেজি স্পষ্ট করে তোলে। তখন তারা ব্যাকলাইন ৭ জনের ও করছিল।

ম্যাচের ৬০ মিনিটে বার্সায় হয়ে পেদ্রি এবং ত্রিনকাও নাম্বার পর বার্সার রাইট সাইডে এটাক আরও বৃদ্ধি পায়। এভাবে খেলা চলার সময় ইঞ্জুরি টাইমে গোলকিপারকে একা পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হন ত্রিনকাও। আবারও ইঞ্জুরি টাইমে মেসির উপর কার্লোসের ফাউলে পেনাল্টি আবেদন উঠে, যা রেফারি না করে দেন। যদিও সেটা তর্কযোগ্য। এভাবেই শেষ হয় ম্যাচটি।

সেভিয়ার হয়ে গতকাল সেরা পারফরমার ছিল কৌন্দে এবং জর্ডান। বার্সার জন্য কাল পজেটিভ দিক ছিল এত ইন্টেন্সিটিফুল দলের বিপক্ষে কোন ডিফেন্সিভ এরর ছাড়াই ম্যাচ শেষ করতে পারা। বিশেষ করে রোনাল্ড আরাউহো খেলেছেন বার্সার হয়ে তার সেরা ম্যাচ৷

কোম্যান এবং লোপেতেগুই দুজনেই তাদের তৃতীয় ম্যাচে এসে পয়েন্ট হারালো। লোপেতেগুই বুঝিয়ে দিয়েছেন সেভিয়া এবার লীগে ভালো কিছু করার প্রত্যয় নিয়েই এগোচ্ছে।

চরম ট্যাকটিকাল ব্যাটেলের এই ম্যাচে কাল সমতাতেই শেষ হয়েছে।

1
$ 0.00
Avatar for Alsha
Written by
3 years ago

Comments