এসিডিটি কি? এর লক্ষণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়
(লুবনা আক্তার লিমা, ৩য় বর্ষ, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ)
আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি সমস্যা হচ্ছে, 'এসিডিটি'। লোকমুখে যা গ্যাস্ট্রিক নামে পরিচিত। বর্তমানে এমন একটি ঘর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে ঘর 'এসিডিটি' নামক রোগমুক্ত। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই এই সমস্যা মহামারী আকার ধারণ করেছে। আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির মতে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশই গ্যাসের সমস্যায় ভুগছেন। প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রতিযোগিতামূলক বর্তমান বিশ্বে আমরা শুধু কাজ নিয়েই ব্যস্ত থেকে ভুলেই যাই আমাদের দৈনন্দিন নিয়মকানুন গুলো, যার ফলেই আক্রান্ত হয়ে ভুগতে থাকি বিভিন্ন রোগে, যার মধ্যে একটি হলো 'এসিডিটি'।
এসিডিটি কি?
মানুষের পাকস্থলীতে প্রতিনিয়ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড (HCl) নিঃসরণ হচ্ছে। খাবারের সময় হলে, খাদ্য দর্শন, খাদ্যের আস্বাদন বা কোন মুখরোচক খাবারের ঘ্রাণ বা মনে পড়লে এই নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা, ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, মানুষিক অবসাদ ইত্যাদি কারণে এসিড নিঃসরণের মাত্রা বাড়ে, আর এই অতিরিক্ত নিঃসৃত এসিড'ই পরবর্তীতেতে সৃষ্টি করে এসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিক।
এসিডিটির ফলে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়ঃ
পাকস্থলীতে অতিরিক্ত বা ভারসাম্যহীন এসিড উৎপন্ন হবার ফলে, পেটের উপরের অংশে ব্যথা বা জ্বালা পোড়া অনুভূত, বুক জ্বালাপোড়া, গ্যাস, বমিভাব, টক ঢেঁকুর, মুখে দুর্গন্ধ, পেট ফাঁপা, ক্ষুধামন্দা, অল্প খেলেই ভরপেট অনুভব, ওজন হ্রাস,পিঠে ও বুকে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এসিডিটি প্রতিরোধের উপায়ঃ
💘 সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণের কোন বিকল্প নেই, এসিডিটির সমস্যা থেকে দূরে থাকতে সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে।
💘 একবারে পেট ভর্তি করে খাওয়া যাবে না।
💘 বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণ।
💘 অতিমাত্রায় চিনিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
💘 খেতে হবে টাটকা খাবার।
💘 ফ্রোজেন ফুড যথাসম্ভব না খাওয়াই ভালো।
💘 নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে যা শরীরকে টক্সিন মুক্ত রাখে।
💘 ঘুমাতে হবে ঠিকঠাক, মানুসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে।
💘 রাতের খাবার ঘুমানোর অন্তত ২ঘন্টা আগে সেরে ফেলুন।
💘 খেয়েই শুয়ে পড়া অনুচিত, সামান্য হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
💘 অতিরিক্ত ওজনকে না বলুন।
💘 অবশ্যই ধূমপান ও মাদকদ্রব্য থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
💘 অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি খাদ্য ও বাইরের খাদ্যকে নিজ খাদ্য তালিকা থেকে বিদায় দিতে হবে।
💘 অতিরিক্ত তেল ও মসলা জাতীয় খাবার খাওয়া যাবেনা।
💘 তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার পরপরই পানি পান না করে, অন্তত ৩০মিনিট পর পানি পান করতে হবে।
💘 ভারী খাবার যেমন, মাংস, বিরিয়ানি, চাইনিজ রাতে না খেয়ে সকালে বা দুপুরের মেন্যুতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
💘 বাসি, পঁচা খাবার খাওয়া যাবেনা।
💘 ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যা ল্যাক্সিটেভ হিসেবে কাজ করে গ্যাস সৃষ্টিতে বাঁধা প্রদান করে এমন খাদ্য নিয়মিত খেতে হবে।
এসিডিটি প্রতিকারে করণীয় ঃ
সমস্যা যেখানে আছে সমাধানও আছে। ধৈর্য্য ধরে কিছুদিন নিয়ম মেনে চললেই মুক্তি পাওয়া যাবে এসিডিটি থেকে।
💜 নিজের খাবার সময়ের রুটিন করুন।
💜 বাইরের ও তেলেভাজা খাবার পরিহার করুন।
💜 যথাসম্ভব ঘরের খাবার খান।
💜 খাবার গ্রহণের পূর্বে পানি পান করুন, খাবার গ্রহণের সময় বারবার পানি পান করবেন না এবং খাওয়ার কিছুক্ষণ পর পানি পান করুন।
💜 অতিরিক্ত ঝাল-মসলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
💜 কিছু প্রাকৃতিক উপায় গ্রহণ করতে পারেন।যেমন, দুটি লং মুখে নিয়ে চিবোতে পারেন যেন এর রস পেটে যায়; তুলসী পাতা খেতে পারেন রস করে (প্রতিদিন ৫-৬টা)। এছাড়াও পুদিনা পাতার রস খেলেও এসিডিটি ও বদহজম থেকে ত্রাণ পাওয়া যায়।
💜 ঠান্ডা দুধ পাকস্থলীর গ্যাস্ট্রিক এসিডকে নিয়ন্ত্রণ করে এসিডিটি থেকে মুক্তি দেয়। দুধে থাকে Ca যা পাকস্থলীতে এসিড তৈরিতে বাঁধা দেয়।
💜 পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করুন,খেতে পারেন ডাবের পানি।
💜 খালি পেটে চা,কফি,কোলা গ্রহণ করাবেন না।
💜 ধুমপান,মাদকদ্রব্য ও অ্যালকোহল বর্জন করুন।
💜 যত্রতত্র ব্যথার ঔষুধ ( NASIDs), খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
💜 ধীরে ধীরে ভালো মত খাবার চিবিয়ে খান।
💜 সহজপাচ্য, সুষম ও আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন।
💜 নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান সেই সাথে ভুলে যান শখ্যতা দুশ্চিতার সাথে।
মনে রাখতে হবে আজকের সামান্য এসিডিটি আগামীতে রূপ নিতে পারে পেপটিক আলসার, গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পাকস্থালীর ক্যান্সারের মত জটিল রোগে।তাই কিছু সহজ নিয়ম মেনে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করুন।