যে রাতে পারুল এর গায়ে হলুদ ছিল। পারুল দুই হাত ভর্তি মেহেদী পরলো। সে রাতেই প্লাবন এর মা হঠাৎ মারা গেলেন। প্লাবন তখন পাশের এলাকায়। একটি পরিত্যাক্ত বাড়ির ছাদে তারই দুই বন্ধু দুঃখ বিলাসের আয়োজন করলো। দুইটি কম্পিউটার স্পীকারে অনবরত গান বেজে চলেছে। হালকা মিউজিকের আবেগঘন গান। এখন বাজছে শাওন ইমরোজের গাওয়া "আমার ভাঙ্গা ঘরের, ভাঙ্গা চালা, ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে, অবাক জোছনা ঢুইকা পরে হাত বাড়াইয়া ডাকে" গানটি। রবি দ্বিতীয়বারের মতো বলল, "বিশ্বাস কর, আর দশটা মিনিট আগে গেলেই পাইতাম। আমি গিয়ে দেখি তালা মেরে লোক বের হয়ে যাচ্ছে। আমি এত অনুরোধ করে বললাম, 'আমাকে এক লিটার মদ দেন। অনেক প্রয়োজন আমার।' তবুও লোকটার মায়া হয়নি।"
প্লাবন কিছু না বলে গান শুনছে। এমন সময় শামীম বলল, "এই গান বন্ধ কর, প্লাবনের বাবা ফোন দিয়েছে।"
শামীম ফোন রিসিভ করে সালাম দিলো। তারপর কিছু একটা শুনে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। রবি আর প্লাবন তাকিয়ে আছে শামীমের দিকে। শামীম যেন বাকরুদ্ধ। শত বোল্ডের বাল্বের আলোতে দেখা যাচ্ছে, শামীমের চোখে মুখে বিষাদের ছাপ। ফোন রেখে দেয়ার পর রবি শামীমের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, "কী হয়েছে? মুখ বাংলার পাঁচের মতো করলি কেন?"
শামীম প্লাবনের দিকে নিচু হয়ে একটু ঝুঁকে বলল, "প্লাবন, আন্টি অনেক অসুস্থ। আঙ্কেল তোর ফোন বন্ধ পেয়ে আমার মোবাইলে ফোন দিয়েছে। তোকে এখনি যেতে বলেছে।"
প্লাবন আর দেরি করেনি। চোখ বন্ধ করে মাথা দু'দিকে নাড়িয়ে ছুটে চলল বাড়ির দিকে। শামীমের চোখ ছলছল করছে। রবি কিছু বুঝার আগেই শামীম বলল, "কাছের মানুষকে সরাসরি মৃত্যুর খবর দিতে হয় না। অসুস্থের কথা বলতে হয়। আমি প্লাবনকে কীভাবে বলব যে তার মা মারা গেছে?"
রবি বলল, কী বলছিস তুই? প্লাবন সহ্য করবে কীভাবে?
শামীম বলল, ছোট্ট এই জীবনে আমাদের অনেক কিছুই সহ্য করতে হয় রবি।
পারুলের হাত দুটি বালিশের উপর রাখা। দুই হাত ভর্তি মেহেদী। আঙ্গুলগুলোও বাদ যায়নি। বাইরে তার ছোট ভাই স্পীকার লাগিয়ে বন্ধুদের সাথে আনন্দ করছে। পারুলের বাবা আছেন বাবুর্চির কাছে। মুরগীর পিছ যেন ছয়টা হয়, সেদিকে তার কড়া নজর। বিকেলে পুটিয়ার হাট থেকে দুধ কিনে এনেছিল দই বসানোর জন্য। সাথে কিনে এনেছে মাটির হাড়ি। পারুলের মা আছে মশলা বাটার কাছে। একটি বিয়ের আয়োজনে কত ধরণের মশলা লাগে। এসব মশলার অনেকগুলোই পারুলের মা চিনে না। কানের পাশ দিয়ে হঠাৎ একেকটা মশা ভনভন করে উঠে। পারুলের সেদিকে মন নেই। তার চোখে একটু আগে মেঘের ঘনঘটা ছিল। কেবলই দুই ফোটা বৃষ্টি গাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে। পারুল ভাবছে তার খালাতো ভাই ইমরানের কথা। ইমরান আর পারুল বছর দুয়েক ধরে একে অন্যকে ভালোবাসে। কিন্তু তাদের দুই পরিবারের কেউ সেই খবর জানতো না। জানতে পেরেছে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর। দিন দশেক আগে গভীর রাতে পারুলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে স্বপ্নে দেখলো, পারুলকে কেউ নৌকায় করে নিয়ে যাচ্ছে। আর ইমরান নদীতে সাতার কেটে চিৎকার করে বলছে, "পারুল আমাকে একা রেখে চলে যেও না।"
যখন তার ঘুম ভাঙ্গলো তখন মধ্য রাত পেরিয়ে গেছে। দরজা খুলে তার মা'কে ডাকলো। পারুলের মা চোখ কচলাতে কচলাতে পারুলের কাছে এসে দেখলো পারুল কাঁদছে। এক পর্যায় তার মা'কে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে লাগলো। পারুলের মা ভেবেছিল, মেয়েটা বিয়ের পর তাদের ছেড়ে যাবে। সেটা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু পারুল বলে উঠলো, "মা এই বিয়েটা আমি করতে চাই না। আমি অন্যজনকে ভালোবাসি।"
পারুল আর বলার সুযোগ পায়নি যে, সে ভালোবাসে ইমরানকে। বলার আগেই পারুলের মা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল, "বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা না, যে ইচ্ছে হলো আর ভেঙ্গে দিবি। সবকিছু ঠিকঠাক, আত্মীয় স্বজন দাওয়াত দেয়া শেষ। আর তুই মধ্য রাতে প্রলাপ শুরু করেছিস?"
সেই রাতে কথাটুকু বলার পর থেকে পারুলের মা পারুলকে চোখের আড়াল হতে দেয়নি। কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই। পারুলের মা এমনিতেই প্লাবন ছেলেটাকে দুই চোখের বিষ মনে করে। পারুলের মা ভেবে বসে আছে, তার মেয়ে নিশ্চয় প্লাবন ছেলেটার পাল্লায় পড়েছে।
প্লাবন বাড়িতে ঢুকার আগেই কান্নার শব্দ পাচ্ছে। তার ছোটো বোনের কান্নার শব্দ। কয়েক বাড়ির মানুষ এসে ভীড় জমিয়েছে। মানুষ বলাবলি করছে, "গতকালও প্লাবনের মা একদম সুস্থ ছিল। আজ সারাটাদিনও অসুখের কোনো বালা নেই। এমন হঠাৎ করে চলে গেল। নিশ্চয় বড় কোনো আঘাত পেয়েছে মনের ভিতর।"
কেউ বলছে, "আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে। বড় ভালো মানুষ ছিল।"
চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে লাশ। মাথার কাছে আগরবাতি সুগন্ধী ছড়াচ্ছে। একটু আগেই প্লাবনের বাবা নিয়ে এসেছে। এতো রাতে বড় বাজার ছাড়া কোনো দোকান খোলা নেই।
প্লাবনের ভিতরটা মুচড়ে যাচ্ছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে। শামীমের কাছে অসুস্থের খবর শুনে দৌড়ে বাড়ি এলো। কিন্তু ছোটো বোনের কান্নার আওয়াজ আর বাড়ি ভর্তি মানুষ ভিন্ন কিছুর জানান দেয়। প্লাবন ঘরে ঢুকে ঢাকা চাদরে নিজের মা'কে দেখতে পেয়ে মা মা বলে হাঁটু গেড়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো। তার দুই চাচি তাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কারো মৃত্যুতে শান্তনা দিতে গেলেও যেন হয়ে উঠে না। চিরদিনের জন্য একটি মানুষ চলে গেলে প্রিয়জনদের কাছে তখন কোনো শান্তনার বাণীই তাদের কষ্টকে হালকা করতে পারে না। তখন কান্নাই পারে শুধু মনকে হালকা করতে। বৃষ্টির মতো ঝর ঝর করে কাঁদতে হবে। তারপর আস্তে ধীরে মন কিছুদিন পর শান্ত হবে। আবার মনে পড়বে, আবারো মনটা কেঁদে উঠবে। জীবনের এই নিয়মগুলো বড়ই নির্মম।
পারুলের ঘুম ভাঙ্গলো খুব সকালে। হাতে মেহেদীর কড়া রং হয়েছে। ইমরান একবার বলেছিল, "জানো পারুল? আমার মনের একটা ইচ্ছে হলো, আমার আর তোমার গায়ে হলুদের রাতে তোমার হাতে মেহেদী পরিয়ে দেব। ছেলে বলে অবজ্ঞা করো না। ইদের চাঁদ রাতে কিন্তু আমি বাচ্চাদের হাতে মেহেদী পরিয়ে দেই।"
পারুল মুচকি হেসে বলেছিল, "গায়ে হলুদে তুমি থাকবে তোমার বাড়ি, আমি থাকবো আমাদের বাড়ি। মেহেদী তো চাইলেই পরাতে পারবে না।"
পারুলের গায়ে হলুদের রাতে ইমরান সত্যিই আসেনি। বাবা মা দাওয়াত করেছে। কাল হয়তো খালা খালু চলে আসবে। কিন্তু ইমরান আসবে না। ভালোবাসার মানুষের অন্য কারো সাথে বিয়ে হবে। আর সে দৃশ্য দেখার মতো মহান প্রেমিক পৃথিবীতে খুব কমই আছে। পারুলের খুব ইচ্ছে করছে ইমরানকে ফোন করে কিছুক্ষণ কেঁদে হালকা হতে। না জানি ইমরান এখন কী করছে। কিছুই জানা হয় না পারুলের। সেদিন রাতে বিয়ে করবে না বলার পরদিনই পারুলের কাছ থেকে মোবাইলটি কেড়ে নিয়েছে তার মা। ঘুম ভাঙ্গার পরও পারুল এক কাত হয়ে শুয়ে দুঃখ বিলাস করছে। বিলাপ করে যদি কাঁদতে পারতো তাহলে হয়তো ভালো লাগতো। কিন্তু জগতে হাসির সীকৃতি থাকলেও কাঁদতে হয় লোকচক্ষুর আড়ালে, লুকিয়ে। মানুষ একটা সময় এসে আর সবার সামনে কাঁদতে পারে না। হাসার মধ্যে লজ্জা না থাকলেও পৃথিবীর মানুষ কান্না করলে লজ্জা পায়।
প্লাবন কান্না না করলেও কিছুক্ষণ পর পরই তার চোখ থেকে নীরবে গড়িয়ে পড়ছে পানি। তার মা জানতো, সে পারুলকে খুব ভালোবাসে। মা তার কাছের বন্ধুর মতো। একই এলাকায় পারুলের বাড়ি হওয়ায় শুধু প্লাবনের মা নয়, এলাকার অনেকেই জানতো প্লাবন পারুলকে ভালোবাসে। পারুলের বাবা মা জানতো তাদের মেয়ের পেছনে প্লাবন ঘুরঘুর করে। তবে সে ভালোবাসা শুধুই একতরফা। বছর দুই ধরে প্লাবন পারুলের জন্য মনের ভিতর ভালোবাসার কুটির সাজিয়ে সেখানে ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু পারুল সে কুটিরের আশেপাশে এলেও কখনো ভিতরে প্রবেশ করেনি। দুইবার প্রেমও নিবেদন করেছিল। প্রথমবার বলেছিল, "প্লাবন ভাই আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না।"
কিন্তু কেন ভালোবাসতে পারবে না সে কথাটি সেদিন বলেনি। বলেছে দ্বিতীয়বার যেদিন প্লাবন আবারো পারুলের কাছে ভালোবাসার কথা জানাতে গিয়েছিল। সেদিন টিপটিপ বৃষ্টি ছিল। প্লাবনের মাথার উপর বড় এক কচুপাতা। পারুল ফিরছিল কলেজ থেকে। পথ আগলে দাঁড়ায়নি প্লাবন। পাশাপাশি হেঁটে কথা বলতে চেয়েছিল। পারুল থেমে গেল। প্রশ্ন করলো, "প্লাবন ভাই কিছু বলবেন?"
প্লাবন আমতা আমতা করে বলেছিল, "তুমি তো জানোই আমি কেন এসেছি। আমার রাতে ঘুম হয় না। শুধু একটি প্রশ্নই বারবার মনে উঁকি দেয়। যাকে জীবনের প্রথম ভালোবাসলাম, সে কেন আমাকে ভালোবাসবে না? আমার মতো করে কেন সে আমাকে ভাববে না?"
আকাশে তখন বিদ্যুৎ চমকায়। হঠাৎ গুরগুর করে মেঘ ডাকে। পারুল বলল, "আমার ভাবার মতো অন্য একজন আছে। ভালোবাসার মতো একজন আছে। ভালোবাসি সেই মানুষটাকে। তাই আপনার ডাকে সাড়া দেয়া সম্ভব না প্লাবন ভাই।"
আকাশ হঠাৎ করে অঝরে কান্না করে দিলো। পারুল ছাতা মাথার উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। প্লাবণ কচুপাতা ফেলে দিয়ে আকাশের কান্নার সাথে একাত্বতা ঘোষণা করলো। নিজেও ঝরেছিল আকাশের মতো করে। আজ মায়ের মৃত্যুতেও প্লাবন থেকে থেকে ঝরেই যাচ্ছে।
আসরের পর জানাজার নামাজ। ওয়াক্ত নামাজের একটু আগেই লাশ নিয়ে রওনা হলো সবাই। প্লাবন খাটিয়ার পেছনের দিকটার ডান পাশে। বড় রাস্তা পেরিয়ে মসজিদ রোডে নামতে হবে। পেছনে এলাকার অনেকেই আছে, যারা জানাজার নামাজে অংশ নিবে। বড় রাস্তায় চারটা গাড়ি দাঁড়ানো সারিবদ্ধভাবে। সামনের গাড়িটা গাঁধা আর গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো। প্লাবন বুঝতে পারে এই গাড়ি দিয়ে পারুলকে নিতে এসেছে। সব বিষাদ, সব দুঃখ যেন একসাথে উদয় হলো।
প্লাবনের আবারো চোখ ভরে পানি এলো। এ পানি পারুলের জন্য নয়। তার মায়ের জন্য। মা'কে প্লাবন অনেক ভালোবাসতো। ভালোবাসার মানুষগুলো কাছের মানুষগুলো কেন যেন খুব দ্রুত ছেড়ে যায়। প্লাবনের এমনটাই মনে হচ্ছিলো।
জগতের নিয়মে সময় কারো জন্যই অপেক্ষা করে না। দিনের পর দিন পেরুতে থাকে। বিয়ের সতেরো দিন পর এক সন্ধ্যা লগনে পারুল পালিয়ে গেছে। বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। বিয়ের দুইদিন পর স্বামী সাথে আসলেও, এবার আর সাথে আসেনি। পারুল বাড়ি এসে গোটা দুইটাদিন কাটালো। বিয়ের পর থেকেই তার চোখ দুটি অঝরে ঝরতে থাকে। কারো আশায় পথের পানে চেয়ে থাকে। তার অবসান ঘটিয়ে বিকেলে ফোন দিলো ইমরানকে। দুদিন আগেই মাত্র ফোনটি নিজের দখলে নিয়েছিল পারুল। ফোন করে ইমরানকে বলল, "আমি আর পারছি না। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ করে হেরে যাচ্ছি। আমাকে এসে নিয়ে যাও ইমরান।"
আর ইমরান পারুলকে নিয়ে বিয়ের আগেই পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারুলকে ফোনে না পেয়ে সেই কাজটি আর সম্পন্ন হয়নি। খুব করে ভেবেছিল, পারুল নিশ্চয় তাকে ফোন দিবে। আর সতেরোদিন পর ফোন পেয়ে পারুলকে বলল, "আমি আসছি। তুমি তৈরী থাকো।"
সন্ধ্যায় সবাই যখন ব্যস্ত। পারুল সুযোগ বুঝে পাশের বাড়িতে যাবার নাম করে এক কাপড়েই বড় রাস্তায় হাজির। আর আগে থেকে অপেক্ষা করা ইমরানের সাথে পাড়ি জমালো অজানার পথে।
প্লাবন সেই সন্ধ্যা রাতে কসবা রেলস্টেশন পাড় হয়ে ছুটে চলেছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রামের নাজিরহাটে প্লাবনের ঘনিষ্ট বন্ধু সজিবের বাড়ি। আগে কখনো যাওয়া হয়নি। সজিব যখন নরসিংদীতে পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পে চাকুরী করতো, তখন থেকে পরিচয় প্লাবনের সাথে। বছর দেড়েক পর প্রকল্পের আওয়াতাধীন কিছু সাইটের কাজ সমাপ্ত হবার পর মাস দুয়েক আগে সজীব ফিরে যায় চট্টগ্রামে। কিন্তু মোবাইলে ঠিকই যোগাযোগ ছিল প্লাবনের সাথে। সপ্তাহখানেক ধরেই সজীব প্লাবনকে বলছে, "এতকিছু যেহেতু ঘটে গেছে। তোর মনটাও যেহেতু বিষাদে পুঁড়ছে। তাহলে একবার ঘুরে যা। আলাদা পরিবেশে থাকলে তোর মনটা অনেক পরিবর্তন হবে। আসব আসব করে আজ সকাল দশটার কর্ণফুলি ট্রেণে প্লাবন রওনা দিয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রাম নেমে সেখান থেকে অক্সিজেন, তারপর অক্সিজেন থেকে নাজিরহাটের বাস ধরতে হবে। এমনটাই ফোনে বলে দিয়েছে সজীব।
পারুলের মা জাহানারা বেগম চিৎকার করে বলছে, "পারুলের বাবা তুমি এখনি থানায় যাও। প্লাবন ছাড়া এই কাজ কেউ করেনি। দুইটা বছর ধরে জ্বালিয়ে মারলো। শেষ পর্যন্ত মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিলাম। তবুও মেয়েটাকে ফুসলিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। আমার মেয়েকে আনতে হবে, তুমি থানায় যাও এখনি।"
পারুলের বাবা ইকবাল হোসেন এতক্ষণ দাঁতে কিড়মিড় করে তাকিয়ে ছিল অন্যদিকে। জাহানারা বেগমের কথা শুনে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, "শার্টটা দাও। আমি এখনি যাচ্ছি। ঐ পোলারে চৌদ্দ শিকের ভাত না খাওয়ানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।"
রাতে সাড়ে নয়টার দিকে থানায় গিয়ে কেইস লিখলেন পারুলের বাবা। দুইটা এক হাজার টাকার নোট গুজে দিয়ে বললেন, "স্যার আপনাদের চা নাস্তার জন্য। আমার মেয়েটাকে খুঁজে এনে দিন স্যার। প্লাবন ছাড়া এই কাজ কেউ করেনি "
পুলিশের এসআই মিজানুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, "আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব। রাতে খোঁজারও চেষ্টা করবো। তবে সকালে আপনি কোর্টে যাবেন। মামলা করে একটা ওয়ারেন্ট নিয়ে আসবেন। তাহলে ঝামেলা কম হবে।"
পরদিন সকাল দশটার দিকে ইকবাল হোসেন প্লাবনের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। মামলা করা হয়েছে ফৌজদারি আইনের ৩৫৯ নং ধারায় মনুষ্য হরণ ও ৩৬২ ধারায় অপহরণ সংক্রান্ত অপরাধ বর্ণিত হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের এই ধারায় উল্লেখ করা আছে, কেউ যদি এই ধারার অপরাধ করে তার শাস্তির বিধান রয়েছে ৩৬৩, ৩৬৪ থেকে ৩৬৯ ধারায়। সাতবছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। তাড়াও হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ হলে দশ বছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ড দেয়া হবে।
পুলিশ গত রাতে প্লাবনের বাড়িতে গিয়ে তাকে খুঁজে পায়নি। অপরাধ সন্দেহাতিকভাবে প্রমাণিত হিসেবেই পুলিশ কেইসটি আমলে নিয়েছে।
প্লাবন এখনো ঘুমে। সজীব তাকে ডাক দেয়নি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্লাবন বেশ ক্লান্ত। গতরাতে সাড়ে নয়টায় চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে একবার ফোন দিয়েছিল সজীবকে। দ্বিতীয়বার ফোন দিয়েছে রাত এগারোটার দিকে, নাজিরহাটে পৌঁছে। নাজিরহাটের "মুসাবিয়া গেইট" নামক স্থানে বাস থেকে নেমে সজীবকে ফোন দিলে সে এসে প্লাবনকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। সজীব আগেই বাড়িতে বলে রেখেছে, আমার বন্ধু প্লাবন বেড়াতে আসবে নরসিংদী থেকে।
তিথী আজ কলেজে যায়নি। যেদিন কলেজে না যাবে সেদিন এই সময়টায় তিথী তার ফুল গাছের পরিচর্চা করে নিজ হাতে। তারপর কোনো এক উপন্যাস নিয়ে ছাদের একপাশটায় পড়তে বসে। তিথীর বাবার সংগ্রহে গোটা এক লাইব্রেরীর মতো বই সংগ্রহে আছে। এছাড়াও তিথীর পছন্দের কোনো বই থাকলে তার ভাই সজীবকে বলে। সজীব আনব না আনব না বলেও শেষ পর্যন্ত একমাত্র বোনের আবদার ফেলতে পারে না। তিথী ফুলগাছের পরিচর্চা শেষে ছাদে বসে বই পড়ছে। তার পড়ায় আজ মন নেই। তার ইচ্ছে করছে রুমে গিয়ে শুয়ে থাকতে। মাঝে মধ্যেই তিথীর মন এমন উদাসীন থাকে। সে বই নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছিলো। পাশের ঘরে তার ভাই সজীব কার সাথে যেন কথা বলছে। নিশ্চয় তার বন্ধুর সাথে। গতকাল বলেছিল, সজীব যেখানে চাকুরী করতো সেখান থেকে তার এক বন্ধু আসবে। তিথী সেদিকে মন না দিয়ে তার ঘরে চলে গেল। গল্পঃ দুঃখ বিলাস
পর্বঃ দুই
ইমরান পারুলকে নিয়ে পালিয়েছে এই খবর তার বাড়ির কেউ জানে না। আর পারুলের বাবা মা তো তাদের ভাবনাতেও আনেনি পারুল ইমরানের সাথে চলে যেতে পারে। তাদের একটাই ধারণা, প্লাবনও বাড়িতে নেই। এই ছেলেটাই তাদের মেয়েটাকে ফুসলিয়ে নিয়ে পালিয়েছে। সকাল হয়ে যাবার পরও পারুলের শ্বশুর বাড়িতে এই খবর দেয়ার মতো সাহস করেনি কেউ। বিয়ের পর মেয়ে পালিয়েছে, এই খবর শুনলে সংসার যে টিকবে না এটা ইকবাল হোসেন ভালো করেই জানেন। তিনি চান যে করে হোক, শ্বশুর বাড়ির লোকজন খবর পাওয়ার আগেই যেন পারুলকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারে।
পারুল আর ইমরান আলাদা ঘরে ঘুমিয়েছে। গতরাতে ইমরান তার ফুপুর বাড়িতে এসে উঠেছে। তার ফুপু তখন এশার নামাজ আদায় করে রাতের খাবারের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। ইমরান বাইরে থেকে ডাক দিলো, "ফুপু দরজা খুলো, আমি ইমরান।"
ইমরানের ফুপু রহিমা খাতুন একটু সময় নিলেন। রাত করে নরসিংদী থেকে গাজীপুরে চলে এলো, ইমরানের বাবার কোনো দুঃসংবাদ নয়তো? আর দুঃসংবাদ হলে তো ফোন করেই বলতে পারতো। যদিও তিনি তার ভাইয়ের সাথে বছর দেড়েক ধরে কথা বলেন না। ওয়ারিশের সম্পত্তি একাই ভোগ দখল করতে চায়। কিন্তু তিনি ইমরানকে অনেক আদর করেন। দরজা খুলে ইমরানের সাথে একটি মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন রহিমা খাতুন। ইমরান বলল, "ফুপু জুঁই কোথায়? তুমি কিছু বুঝবে না। জুঁইকে আমি সব বুঝিয়ে বলছি।"
জুঁই ততোক্ষণে তার মায়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলছে, "আরে ইমরান ভাই, রাতের বেলা পরীর দেখা পেলে নাকি?"
ইমরান বলল, "ওর নাম পারুল। আজ রাতে ও তোর সাথে থাকবে। আর বাকিটা তোকে বুঝিয়ে বলতে হবে? তোকে তো আগেও বলেছি পারুলের কথা।"
জুঁই চোখ বড় বড় করে জানতে চাইলো, "তার মানে ইমরান ভাই তোমরা পালিয়েছো? মামা জানলে তো তোমাকে আস্ত রাখবে না।"
-সেজন্যই তো তোদের এখানে এসেছি। তুই ফুপুকে একটু বুঝিয়ে বল।"
রহিমা খাতুন বললেন, "হইছে হইছে। এতটুকু বুঝার বয়স হইছে। এই জুঁই, মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে যা। আমি খাবারের ব্যাবস্থা করি। আর ইমরান, তুই বাংলা ঘরটা খুলে ধোয়া চাদর আছে বিছিয়ে নে একটু। আল্লাহ জানে আমার উপর কী বিপদ নিয়ে আসলি।"
পারুল রাতের খাবার খেয়ে জুঁইয়ের সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু সে জানে না, তার বাবা প্লাবনের নামে মামলা করেছে, তাকেই অপহরণের দায়ে।
প্লাবনের বাবা আতাউর রহমান সাদাসিধে মানুষ। পুলিশ, মামলা মোকাদ্দমা এগুলো খুব ভয় পান। রাতে যখন পুলিশ এসে গেইটে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলছে, "বাড়িতে কে আছে? গেইট খুলুন। আমরা আইনের লোক।"
আতাউর রহমান তার স্ত্রী গত হবার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জেগেই থাকেন। বড্ড একা হয়ে গেলেন স্ত্রীকে হারিয়ে। গেইট খুলে পুলিশ দেখে জানতে চাইলেন, "কী ব্যাপার? আপনারা হঠাৎ আমার বাড়িতে?"
পুলিশের এসআই বললেন, "প্লাবন কি আপনার ছেলে? সে কোথায়? তার নামে অপহরণের কেইস আছে।"
আতাউর রহমানের মাথায় যেন বাজ পড়লো। তিনি বললেন, "আমার ছেলে সকালেই চট্টগ্রামে গেছে তার বন্ধুর বাড়িতে। সে কীভাবে অপহরণ করবে?
পুলিশ বলল, "চট্টগ্রাম গেছে না মেয়ে নিয়ে পালিয়েছে তা আমরা বের করবো। আপনার ছেলের ফোন নাম্বারটা দিন একটু।"
আতাউর রহমান কী মনে করে যেন প্লাবনের নাম্বারটা একটা কাগজে লিখে দিলো। কিন্তু পুলিশের এসআই সে নাম্বারে কোনো ফোন না দিয়ে কাগজটি নিয়ে চলে গেল। রাত পেরিয়ে ভোর সকালে আতাউর রহমান ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠেই ছুটলেন মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড করার জন্য। তারপর প্লাবনকে ফোন করে সবকিছু বললেন। এটাও বলে দিলেন যে, পুলিশ ফোন দিলে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলিস সবকিছু। আর বন্ধুর বাড়িতেই থাক আপাতত। দেখি এদিকে কী হয়?"আতাউর রহমান ফোন রেখে ছুটলেন পারুলের বাবার কাছে। তার ছেলেটা গতকাল সকালে রওনা দিলো চট্টগ্রামে। তাদের মেয়ে পালিয়েছে রাতে। তাহলে প্লাবনের নামে মামলা করবে কেন?
সজিব বাজার করতে গেছে। এত দূর থেকে বন্ধুটা আসছে, তাকে ভালো-মন্দ না খাওয়ালে হয়? কিন্তু প্লাবনকে ঘরেই রেখে এসেছে। তাকে সাথে আনলে ভালো হতো। একা একা ঘরে বসে আছে ছেলেটা। সেটা মনে করে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধ জন্ম নিল সজিবের।
প্লাবন তখন সজিবের রুমের ভিতর চোখের পানি মুছে। যাকে এতোটা ভালোবাসলো, তাকে তো পাওয়া হলো না। আর উল্টো অপহরণ মামলার আসামী। মা'কে হারানোর পর থেকে এমনি স্বাভাবিক হতে পারেনি প্লাবন। জন্মের পর কোনো নালিশ যায়নি বাড়িতে আর এখন পুলিশ গেল। প্লাবন চোখের পানি মুছে আর ভাবে তার অপরাধ কতটুকু? ভালোবাসাটাই তবে অপরাধ।
তিথি তাদের বাড়িতে তার বাবার গড়া সেই ছোট্ট লাইব্রেরীতে বই রাখতে যাচ্ছে। আজ আর বই পড়া হয়নি। যাবার সময় সজিবের রুমের দিকে চোখ পড়লো তিথীর। নিজেকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, সে কি সত্যটাই দেখেছে। এক পা পিছিয়ে আবারো তাকিয়ে দেখল, ঘটনা সত্য। সজিবের বন্ধু কাঁদছে। ছেলে মানুষ বুঝি এভাবে কাঁদে? চোখের পানি মুছে আর কাঁদে। তিথী বই রেখে দ্রুত তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, "মা, ভাইয়ের বন্ধু কাঁদছে। কেন কাঁদছে বলতে পারো?"
তিথীর মা নিজেও অবাক হয়ে বললেন, "তুই সত্যি বলছিস? ছেলেটা কাঁদছে? চল তো কী হয়েছে একটু জেনে আসি। আমার বাড়ির অতিথী ছেলেটা। কী হয়েছে জানাটা দরকার।"
তিথীর মা আনোয়ারা বেগম ঘরে ঢুকার সাথে সাথে প্লাবন তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো। যেন কিছুই হয়নি। তিথী তার মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে একপাশে কাত হয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে। আনোয়ারা বেগম প্লাবনের পাশে বসলেন। জানতে চাইলেন, "কী হয়েছে বাবা? তুমি কাঁদছো কেন? আমরা কি তোমাকে কোনো কষ্ট দিয়েছি?"
প্লাবন মাথা না তুলেই বলল, "না আন্টি। আপনারা কেন কষ্ট দিতে যাবেন? ভাগ্যে কষ্ট লেখা থাকলে কারো দিতে হয় না, এমনি পাওয়া যায়। মা'কে আমি খুব ভালোবাসতাম। দিন বিশেক আগে তিনি মারা গেলেন। আমার কতোটা কষ্ট হবে মা সেটা জেনেও চলে গেলেন।"
কথাটুকু বলার পর আবারো দুই চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ছে প্লাবনের। আনোয়ারা বেগম প্লাবনের মাথায় হাত রাখলেন। চোখের পানিও মুছে দিলেন নিজের আঁচল দিয়ে। বললেন, "আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের ভালোবেসে তাড়াতাড়ি তার কাছে নিয়ে যায়। তুমি মায়ের জন্য দোয়া করো বাবা। আর আমরা তো আছি। একদম কষ্ট পাবে না বাবা। সজিব টা যে কী? ছেলেটাকে একা ঘরে রেখে গেছে। একা থাকলে মন খারাপ হয় বেশি।"
প্লাবন বলল, "না আন্টি ঠিক আছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তাই কান্না পেয়েছিল। এখন ঠিক আছি।"
আনোয়ারা বেগম তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, "ঘরে এতো এতো বই। তিথী তুই কয়েকটা বই এনে দে তো। তাহলে আর একা লাগবে না।"
তিথী মুখে কিছু না বলে ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলো।
ইমরানের ফুপু চেয়েছিল পারুল আর ইমরানের বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে। বিবাহ ছাড়া পালিয়ে আসা ছেলে-মেয়ে একই বাড়িতে এভাবে থাকাটা বেমানান। মানুষজন শুনলেও মন্দ বলবে। বিয়ের পর না হয় ওদের বাবা মা যতদিন মেনে না নেয় ততোদিন এখানে থাকলো। কিন্তু জুঁই যখন বলল, "মা ইমরান ভাই তো মেয়েটার বিয়ের পর তাকে নিয়ে পালিয়েছে। আগে মেয়েটার ডিভোর্স দিতে হবে তার স্বামীকে। তারপর ইমরান ভাইয়ের বিয়ে করতে হবে।"
রহিমা খাতুন এই কথা শুনে দাঁড়ানো থেকে সোফায় বসে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন, এটা তো বিশাল ঝামেলার কাজ।
রহিমা খাতুনের দেবর কোর্টের মূহূরী। জজের সামনে কাগজপত্র পেশ করে নাকি এমন একটা কাজই হবে। তবুও কোর্টে যেহেতু কাজ করে, নিশ্চয় এই সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে। তাই ফোন দিলেন দেবরকে। ফোন করার পর যা জানতে পারলো তাতে মাথা ভনভন করার অবস্থা। ইমরানকে ডাকলেন রহিমা খাতুন। পারুলও এসেছে সাথে। রহিমা খাতুন বললেন, "ইমরান তুই তো অনেক বড় ঝামেলা লাগিয়ে দিলি। মেয়ের যে বিয়ে হয়েছিল তা তো জানতাম না। এখন তোদের বিয়েটা আইনের বাঁধা আছে।"
ইমরান বলল, "কেন ফুপু? পারুল তো ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে রাজী আছে।"
রহিমা খাতুন বললেন, "ডিভোর্স পেপারে সাইন করলেই ঝামেলা শেষ হবে না। পেপারে সাইন করার নব্বই দিন পর ডিভোর্স কার্যকর হবে। ইদ্দতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই নব্বই দিন অপেক্ষাকে ইদ্দতকাল বলে। মেয়েটার গর্ভে বাচ্চা আসবে কি-না সে জন্যই ইদ্দতকাল। গর্ভে বাচ্চা এলে ডিভোর্স হবে না।'
ইমরানও এই কথা শোনার পর বসে পড়লো সোফায়। এই তিন মাস কোথায় থাকবে তারা? যে পর্যন্ত বিয়ে না হয় সে পর্যন্ত তো চিন্তা দূর হবে না।
প্লাবনের বাবা আতাউর রহমান পারুলদের বাড়ি গেলেন। পারুলের বাবার কাছে একই কথা বললেন। "আমার ছেলে গতকাল সকালের ট্রেনে চট্টগ্রাম গেছে। আপনাদের মেয়ে কার না কার সাথে রাতে পালিয়েছে। আমার ছেলের নামে মামলা কেন?"
পারুলের বাবা বললেন, "দেখুন এমনিতে আমাদের মন মেজাজ ভালো না। আপনি আর মাথাটা গরম করে দিবেন না। আপনার ছেলে বছরের পর বছর আমার মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করছে। আমরা মামলা করেছি। যদি আপনার ছেলে নির্দোষ হয় তাহলে তো আর তার শাস্তি হবে না।"
আতাউর রহমান বাড়ি ফিরে এলেন। এই বছরটা তার ভালো যাচ্ছে না। একের পর এক বিপদ এসে দরজায় কড়া নাড়ছে।
তিথী ছোট্ট লাইব্রেরী থেকে প্লাবনের জন্য কোনো বই পছন্দ করতে পারলো না। সে কী ধরণের বই পছন্দ করে এটা তার অজানা। তাই তিথী ফিরে এলো প্লাবনের কাছে। এসে দেখে তিথীর মা এখান থেকে চলে গেছে। হুট করে এসে তিথী কিছুটা বিব্রতবোধ করছে। তবুও প্লাবনকে উদ্দেশ্য করে বলল, "আসলে আপনি কী ধরনের বই পছন্দ করেন তা তো জানি না। একটু আসুন, আপনার পছন্দমত বই নিয়ে যান।"
প্লাবন বাধ্য ছেলের মতো তিথীর পেছন পেছন গেল। ছোট্ট লাইব্রেরীতে বইয়ের সংখ্যা চার পাঁচশোর কম হবে না। প্লাবন বই বাছাই করছে। 'শঙ্খনীল কারাগার, পরীনিতা, পাহাড়ি ললনা, ডঃ লুৎফর রহমানের রচনা সমগ্র।' বইগুলো হাতে নিয়ে প্লাবন বলল, "এগুলোতেই আমার কয়েকদিন কেটে যাবে। আমি তো আর বেশিদিন থাকবো না। বেশি বই লাগবে না।"
তিথী ভদ্রতার খাতিরেই হোক বা আন্তরিকতার জন্যই হোক প্লাবনের উদ্দেশ্যে বলল, "কেন থাকবেন না বেশি দিন? যতদিন ইচ্ছে থাকবেন। দেখবেন সজিব ভাই আপনাকে সহজে যেতে দিবে না।"
সজিব ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বই নিয়ে ফিরলো।
তিথী তাকিয়ে ছিল প্লাবনের পেছন দিক থেকে। এক হাতের তালুতে আরেক হাতের কনুই ভর রেখে গালে হাত দিল তিথী। সেই হাতেরই একটা আঙ্গুল কপালের কাছে নাড়িয়ে বুদ্ধিমতি মেয়েদের মতো ভাব।
.......
অনেক লম্বা গল্প, কষ্ট করে লিখার জন্য ধন্যবাদ