#প্রসঙ্গঃ ডায়েট ও আমাদের অল্প স্বল্প গল্প
ডায়েট কী?
আমাদের অনেকেরই ডায়েট নিয়ে সঠিক কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। যেহেতু আমি কোন মেডিকেল পার্সন নই তাই এখানে আমি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে আলোচনা করব। আশা করি সবাই আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন এবং ভুল ত্রুটি হলে সংশোধন করে দিবেন। আপনারা অংশ না নিলে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হবে না।
ডায়েট হচ্ছে খাদ্য ও পুষ্টির সঠিক ও স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনা আসলে কী?? এটা কী বয়স, উচ্চতা, ওজনভেদে সবার জন্যে একই?
এটা কী ভাত কম খাওয়া? অথবা চিনি না খাওয়া? যদি কারো রক্তে সুগার ও শর্করার পরিমাণ কম থাকে কিংবা কারো ব্লাড প্রেশার লো থাকে তাহলে তিনি যদি কম ভাত বা কম চিনি খান তাহলে কী হবে?
কিংবা প্রচুর পানি খাওয়া? কারো যদি কিডনি সমস্যা থাকে অথচ তিনি জানেন না তাহলে এই প্রচুর পানি খাওয়া তার কিডনি পুরোপুরি বিকল করে দিতে পারে। ওজন, উচ্চতা ও পরিশ্রমের ধরণ অনুযায়ী পানির পরিমাণও পরিমিত হতে হবে। আবার কাউকে দেখা যায় ঘুম থেকে উঠেই একবারেই এক লিটার পানি খেয়ে ফেলেন! একসঙ্গে এক লিটার না খেয়ে সময় গ্যাপ দিয়ে খাওয়া উত্তম। আমাকে যদি এক বসায় কোন বিশ্রাম না নিয়ে সারাদিনের সব কাজ করে ফেলতে বলা হয় তাহলে আমি কষ্ট করে হলেও করে ফেলব কিন্তু আমার শরীর ক্লান্ত হবে, চাপ পড়বে আমার উপর। ফলাফল আমার কর্মদক্ষতা কমে যাবে বা বিকল হয়ে বিছানায় পড়ে যাব। অতিরিক্ত কাজ করে আমাদের মা/দাদীদের অসুস্থ হওয়ার গল্প কী আছে না আমাদের চোখের সামনে? তাই এক মুহূর্তে একসঙ্গে চার গ্লাশ পানি দিয়ে কিডনির উপর একসঙ্গে সব চাপ না দিয়ে আধা ঘন্টা বা একঘন্টা গ্যাপ দিয়ে খাওয়া ভালো।
আরো জরুরি বিষয় হচ্ছে পানি হোক বা খাবার, একসঙ্গে অতিরিক্ত খেয়ে ফেললে পাকস্থলীর সাইজ বড় হয়ে যায়। আমার পাকস্থলীর ধারণক্ষমতা আছে হয়ত এক পোয়া খাবার বা পানির কিন্তু আমি যদি ডেইলি আধা কেজি করে একবসায় খেয়ে ফেলি তবে নিশ্চিত পাকস্থলী তার স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে নিজের স্বাভাবিক শেইপ থেকে বড় হয়ে যাবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কিছু সম্মানিত পুলিশ সদস্যদের দিকে তাকালে দেখবেন একেকজনের বিশাল ভুঁড়ি। তারা কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম করে, প্রচুর হাঁটাহাঁটিও করে। ডিউটি টাইমে Exercise এর উপরেই থাকে। তাহলে তাদের পেটের শেইপটা এমন কেন!! কারণ ব্যস্ততার কারণে এক বসায় অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেন। যে খাবারটা চার/পাঁচ ঘন্টায় ভাগ ভাগ করে খাওয়ার কথা সেটা ব্যস্ততার কারণে অথবা না জানার কারণে একবেলাতেই পাকস্থলীতে চালান করে দেন। ফলাফল- বিশাল ভুঁড়ির মালিক বনে যাওয়া! আর বেড়ে যাওয়া এই পাকস্থলীর সাইজ কমাতে হলে অপারেশন করাতে হয়। আদনান সামী যে অপারেশনটা করেছিলেন যার স্বাস্থ্য ঝুঁকি মারাত্মক। এগুলো উদাহরণ দিলাম মাত্র।
আমাদের মেয়েদের বেলাতেও ঘটনাটা কিন্তু একই রকম। বরং আরেকটু বেশিই শোচনীয়। বেঁচে যাওয়া খাবার ফেলে দিতে আমাদের খারাপ লাগে তাই আগের দিনের খাবার আর কেউ খায় না বলে আমরা ক্ষুধা না থাকলেও সকল উদ্বৃত্ত খেয়ে খাবারের সাশ্রয় করে থাকি। অথচ খাবারের সাশ্রয় করতে গিয়ে অসময়ে বা অতিরিক্ত খেয়ে নিজের স্বাস্থ্যের যে ভীষণ ক্ষতি করি তা বয়স 50 এর আগে বুঝতেই পারি না। আর যখন বুঝি তখন আর পেছনে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় থাকে না। সামান্য খাবার বাঁচাতে যে উদ্বৃত্ত খাবার নিজের পাকস্থলীতে চালান করেছিলাম একসময়, তার বহুগুন বেশি খরচ দিয়ে পরবর্তী জীবনে ডাক্তার দেখাই, ঔষধ খাই, ট্রিটমেন্ট নেই! কারো কারো তো জায়গা জমিও বিক্রি করতে হয়, ধার করতে হয়!
যদি আপনার খাবারের সময় না হয় আর পাকস্থলীতে ক্ষুধা না থাকে তাহলে খাবার পঁচে যাবে শুধুমাত্র এই কারণে অন্তত অপ্রয়োজনীয় খাবার নিজে খাবেন না। অন্য কেউ না খেলে ফেলে দিন। ডাস্টবিন থেকে কুকুর/বিড়াল/পশুপাখি এগুলো খাবে। এই খাবারগুলো ওদের হক। ওদেরকেও তো বেঁচে থাকতে হবে তাই না! পৃথিবীটাতো ওদেরও।
যারা খুব ভালো রান্না করেন ও পারেন অর্থাৎ যাদের রান্নার সুনাম আছে তাদের জন্য কিছু আগাম সচেতনতা। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি অনুসারে আমাদের ভালো রান্না মানেই ধরে নেওয়া হয় অস্বাস্থ্যকর খাবার। আর ভালো রান্না মানেই পরিবারের সদস্যরা বেশি বেশি পছন্দ করে বেশি বেশি খেয়ে ফেলবে! এরপর যদি পরিবারের কেউ ফ্যাটি লিভার বা কোলেস্টেরল এ আক্রান্ত হন তাহলে পাকা রাঁধুনী কিন্তু দায় এড়াতে পারেন না হোক তিনি রোগীর মা বা স্ত্রী বা কন্যা বা পূত্রবধূ। তাই পরিবারের যদি কারো ফ্যাটি লিভার/কোলেস্টেরল/লিভার সিরোসিস/হার্ট এটাক/স্ট্রোক এই রোগগুলো হওয়ার ইতিহাস থেকে থাকে তবে বুঝতে হবে সেই বাসার রান্না ও খাবার পদ্ধতিতে মারাত্মক ভুল আছে। তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্যাভ্যাস পাল্টাতে হবে। রান্নার ধরণ পাল্টাতে হবে। আর অবশ্যই 20+ বয়সের প্রতি সদস্যকে লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। কারণ আগে আগে আঁচ করা গেলে সচেতন হওয়া যায় যেহেতু এই রোগগুলো আমাদের শরীরে বাসা বাঁধে চুপিসারেই। শেষ পর্যায়ে ধরা পড়লে তো সব শেষ ততদিনে।
আরো যুক্ত করে দেই। আপনি ভীষণ শুকনা। কিন্তু প্রচুর খাবার খান। বিশেষ করে ভাত/চিনি/তেল জাতীয় খাবার। আপনি শুকনা বলে যে ফ্যাটি লিভার বা কোলেস্টেরল হবে না বা কিডনি বিকল হবে না এই দিবাস্বপ্ন প্লিজ দেখবেন না। এই রোগগুলো ওজনের চেয়ে ও বেশি আপনার খাবারের পরিমাণের উপরে নির্ভর করে।
তাহলে কী মানে দাঁড়ালো? ডায়েট করতে হবে নিজের শরীরের অবস্থা বুঝে। এখন এই অবস্থাটা আমরা কিভাবে বুঝব? শরীরের আভ্যন্তরীণ অংশগুলোতো খালি চোখে দেখা যায় না। তো??
হ্যাঁ রুটিন চেকআপ এর মাধ্যমে। টেস্ট করে।
আমাদের বাসার ফার্নিচারগুলোও তো মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করতে হয়, মুছতে হয়, রক্ষনাবেক্ষন করতে হয়। অথচ নিজের শরীরের হার্ট/লিভার/কিডনীর রক্ষনাবেক্ষন কী লাগবে না? নিশ্চয়ই লাগবে। বাঁচতে হবে তো অনেক দিন।
অনেক উন্নত দেশেই বছর বছর মানুষের হেলথের রুটিন চেকআপ করানো হয় বাধ্যতামূলকভাবে। তাই আগাম সমস্যা ধরতে পারায় তারা আগে আগে ট্রিটমেন্ট নিয়ে নিতে পারে। অথচ আমাদের দেশে শেষ মুহুর্ত ছাড়া আমরা ডাক্তারের কাছেই যেতে চাইনা 😰।
যদি নীচের বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে তবে অবশ্যই রুটিন চেকআপটা করিয়ে নিবেন প্লিজ-
- ওজন বেশি হয় (বয়স যাই হোক 20 বা 32),
- বয়স 30+ হলে,
- পরিবারের কারো এই জাতীয় রোগের ইতিহাস থাকলে,
- বাসায় রিচ ফুড বেশি রান্না হলে,
- হঠাত করে চেহারায় ভাঁজ পড়লে বা বয়সের ছাপ পড়লে। চোখের আশেপাশে গুড়ি গুড়ি গোটার মতো দেখা দিলে বা গলা ও ঘাড়ে অতিরিক্ত কালো দাগ হয়ে গেলে (ধরে নেওয়া যায় আপনার লিভারে কোলেস্টেরল জমা হয়েছে),
- এছাড়া অন্য কোন দৃশ্যমান পরিবর্তন।
যে যে টেস্টগুলো করাবেন-
- Whole abdomen ultrasound (12 hours fasting এ যেতে হবে। পানি খাওয়া যাবে। urine এর প্রেশার থাকতে হবে।)
- লিপিড প্রোফাইল (লিভারের চর্বি বা কোলেস্টেরলের পরিমাণ)
- ডায়াবেটিস
- S creatinin (কিডনির)
- থাইরয়েড (t3, t4, Tsh)
- Blood cbc
- Ecg (heart এর)
যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে সবগুলো করিয়ে নিন প্লিজ। দশ হাজার টাকার মতো লাগবে বড়জোর বারডেম হসপিটালে (শাহবাগ)। বছরে দুইটা ড্রেস না হয় কম কিনলেন। আর সামর্থ্য কম থাকলে উপর থেকে শুরু করে যে কয়টা সম্ভব। এগুলো একটা করলে অন্যগুলোর অবস্থা ও আন্দাজ করা যায়। একটাই অন্যগুলোকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে।
যেমন আপনার সারাজীবন প্রেশার ছিল লো। কিন্তু গত এক বছর ধরে ভীষণ মাথা ব্যথা। আপনি ডাক্তার না দেখিয়ে প্রেশার না চেক করে ফার্মেসি থেকে নাপা এনে খেয়ে মাথা ব্যথা সারিয়ে তোলেন। অথচ এদিকে uncontrolled হাই প্রেশার এর কারণে কিডনি বিকল হওয়া শুরু হয়েছে আপনার কোন খবরই নেই। আপনি ইচ্ছেমত চা/কফি/বার্গার/চিরতার রস/আপেল সিডার ভিনেগার খেয়ে যাচ্ছেন। হঠাত একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। তারপর টেস্ট করে জানা যাবে কিডনি অলরেডি ৮০% damaged. পেছন ফেরার কোন উপায় নেই আর! এখানে হাই প্রেশার কিডনি রোগকেও টেনে নিয়ে এসেছে। তাই সময় সময় ব্লাড প্রেশার চেক করিয়ে নেওয়া ও দরকার।
অনেকেই রাতে কম ঘুমান বা দেরী করে ঘুমান। যা লিভারের জন্য খুব ক্ষতিকর। ফ্যাটি লিভার এবং থাইরয়েড হওয়ার অন্যতম কারণ এই কম ঘুম বা না ঘুমানো বা দেরিতে ঘুমানো।
আবার অনেকে ভাবেন যে কোলেস্টেরল হয়ত তেল/চর্বি/মাংস খেলেই শুধু হয়। নিশ্চিন্ত মনে ভাত, রুটি, আলু আর চিনি খেয়েই যাচ্ছেন। অথচ জানেন না যে অতিরিক্ত ভাত বা চিনি লিভারে চর্বি হিসেবে জমে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়।
আবার মেয়েদের ক্ষেত্রে after delivery এই জাতীয় সমস্যাগুলো বেশি করে শুরু হয়। যেহেতু pregnancy and lactating period এ মায়েদের লাইফস্টাইল পুরো পাল্টে যায়। খুব বেশি যত্নও তো পায় না আমাদের মায়েরা। তাই বেবি হওয়ার দুই বছর পরেই টেস্টগুলো করিয়ে নিলে সচেতন ও সতর্ক হওয়া যায়।
টেস্ট না করালে শরীরে কী কী পুষ্টি ঘাটতি আছে জানা যাবে না। আবার কোন খাবারটা আপনার শরীরের জন্য হুমকিস্বরূপ তাও জানা যাবে না। তাই ডায়েট শুরু করার আগে টেস্টগুলো করিয়ে নেওয়া ভালো। আর এরপর একজন পুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট প্লান করতে হবে। কারণ খাবারের পরিমাণ কতটুকু আর কোন খাবারটা খেতে হবে তা নিজে নিজে প্লান করলে বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
আর আমাদের সবাইকেই প্রতিদিন কিছু free hand exercise করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন যারা সাধারণত ঘরে থাকেন। তাই নিয়ম করে দশ মিনিটের জন্য হলেও free hand exercise করতেই হবে সবাইকে। মনে রাখা ভালো সারাদিন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে প্রচুর রান্না করলাম মানেই কিন্তু exercise এর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে যেকোন ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেই সঠিক উত্তর পাবেন। যদিও আমাদের দেশের অনেক ডাক্তাররা নিজেরাই নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে অনেকটাই উদাসীন মনে হয়। খুব unhealthy একটা physical feature নিয়ে health নিয়ে যখন কথা বলেন তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তিনি নিজে কেন সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করছেন না! ডাক্তার যদি নিজে healthy lifestyle follow করেন তাহলেই তো রোগীরা inspired হবে।
সবাই সুস্থ থাকুন।