সেদিনও আমার খারাপ লাগেনি যেদিন আমার ছাত্রী আমার গালে থাপ্পড় মেরে বলেছিল,
" আপনার মতো একজন মানুষ কখনোই শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। আপনি কিভাবে পারলেন নিজের ছাত্রীর বুকে হাত দিতে?
লজ্জা করলো না আপনার? আপনার মতো মানুষকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত। টিউশনির নামে আপনারা লুচ্চামি করে বেড়ান। ছাত্রীদের অসহায়ত্ব এর সুযোগ নেন।"
এসব কথা যখন আমার ছাত্রী তাঁর বাবা মায়ের সামনে বলেছিল তখন তাঁর বাবা মা সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল।
সেদিন আমি কোনো কথা বলতে পারিনি,বোবা হয়ে গেছিলাম আমার ছাত্রীর কথা শুনে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অপমান করে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
আমার অপরাধ ছিল আমি আমার ছাত্রীকে নেশা করতে দেখেছিলাম। মাঝে মাঝেই সে নেশা করতো। ইয়াবা খেতো। সে যখন জানতে পারলো আমি তাকে এসব খেতে দেখেছি এবং তাঁর মা বাবার কাছে আমি তাঁর সমস্ত কুকর্ম বলে দিবো। তখনই সে ঘৃণিত কাজটা করলো আমার সাথে। তবে আমি ভেবেছিলাম আমার ছাত্রী জানে না যে তাকে আমি এসব খেতে দেখেছি। সেজন্যই আজকে পড়ানো শেষে ওর বাবা মার কাছে সব বলে দিবো বলে ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু যখন আমার ছাত্রী আমাকে অপমান করলো তখন বুঝতে পারলাম। সে আগে থেকেই জানতো আমি তাঁর বাবা মাকে এসব বলে দিতে পারি। তাই সে আজ আমার সাথে এমন করলো।
সত্যি বলতে সেদিনও আমার ওতেটা খারাপ লাগেনি যতোটা আজ লাগছে। ওইদিন রাস্তা দিয়ে আসার সময় শুধু দুচোখ দিয়ে বৃষ্টির পানির মতো জ্বল ফেলেছিলাম আর ভেবেছিলাম। মানুষ নিজের প্রয়োজনে এতোটা স্বার্থপর কিভাবে হতে পারে? নিজের প্রয়োজনে কিভাবে একজন মানুষকে এতো বাজে ভাবে অপমান করতে পারে? কিন্তু সেদিন আমি আমার প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুুঁজে পাইনি। তবে সেদিন একটা জিনিস উপলব্ধি করেছিলাম। নিজের প্রয়োজনে মানুষ পৃৃথিবীর সবচয়ে জঘন্যতম কাজটা করতেও দ্বিধাবোধ করবে না।
সত্যি বলছি সেদিনও ওতটা খারাপ লাগেনি যতোটা আজ লাগছে।
আজ আমার বাবা আমাকে বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য বের করে দিয়েছেন। আমার সৎ মা বাবাকে বলেছে আমি নাকি তাঁর দিকে খারাপ নজরে তাকাই। তাঁর মেয়েকে নিজের বোনের মতো দেখি না,আদর করি না। তাঁর ছেলেকে সুযোগ পেলেই গায়ে হাত তুলি। অথচ সৎ মা হলেও তাকে আমি নিজের মায়ের মতোই ভালোবাসতাম,শ্রদ্ধা করতাম। আমি জানি না সে কিভাবে একজন মা হয়ে এমন কথা বলতে পারলো। আমার বোনকে কখনো তুই করেও বলিনি কোনোদিন। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তাঁর জন্য উপহার কিনতাম। কিন্তু আজ এসব কিছুই মিথ্যা হয়ে গেছে। মায়ের কথাটাই বাবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
বাবাকে বলেছিলাম আমি কোথায় যাবো? তোমরা ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কে আছে?
আমাকে অন্তত কয়েকটা দিন থাকতে দাও। একটা কাজ জোগাড় করতে পারলেই চলে যাবো। কিন্তু আমার সমুদ্র ভরা ভেজা চোখ দুটোও বাবার হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে নি। আমি সেদিনের রাতটাও থাকতে পারিনি আমার বাড়িতে।
আজ সাতদিন হয়েছে বাড়ি থেকে চলে এসেছি। কিন্তু চলে আসার সময় যে খারাপ লাগাটা সাথে নিয়ে এসেছি সেটা এখনও রয়ে গেছে। অথচ ছাত্রীর বাড়িতে যেদিন অপমান হয়েছিলাম সেদিন শুধু চোখের জ্বল ফেলেছিলাম। পরে সব ভুলে না গেলেও মনে হতো না,কষ্ট পেতাম না। কিন্তু বাড়ি থেকে আসার সময় যে দুঃখটা পেয়েছি সেটা এখনো ভুলতে পারিনি।
অন্ধকার রুমে বসে যখন নীরবে চোখের পানি ফেলছিলাম তখনই ফোনটা বেজে উঠে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি ইসরাত এর ফোন। ইসরাত আমার গার্লফ্রেন্ড। তিনবছরের সম্পর্ক আমাদের। মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটা আমাকে অনেক ভালোবাসে,কিন্তু আমি তাকে আজ পর্যন্ত কিছুই দিতে পারিনি। রিসিভ করতেই ওপাশে ধমকের শব্দ শুনতে পাই।
ফোন ধরো না কেনো?
তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। দেখা করো আজকে।
- আমি মানসিক ভাবে ভালো নেই। কয়েকদিন পর দেখা করি?
- না,আজ এখনই দেখা করতে হবে।
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ইসরাতের সাথে দেখা করলাম।
কিন্তু সেও আমার দুঃখটা বুঝেনি।
আমি সিদ্বান্ত নিয়েছি তোমার সাথে আর থাকবো না আমি। বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করবো ভেবেছি। আমাদের সম্পর্কের তিন বছর হয়ে গেছে অথচ তোমার কোনো পরিবর্তন দেখি না আমি। অনার্স শেষ হয়েছে তোমার এক বছর হলো। এখন পর্যন্ত কোন চাকরির ব্যবস্থা করতে পারো নি তুমি। ভবিষ্যত নিয়ে কোনো চিন্তা নেই তোমার। এভাবে চলে না আমিনুল। চল শেষ করি সব।
- অনেক আগেই তুমি আমার থেকে দূরে সরে গিয়েছো। আজ শুধু আমাকে জানাতে এসেছো। আমি আসলেও তোমার যোগ্য না। এতো দিন জানতাম ভালোবাসতে অন্তত টাকা লাগে না। পৃৃথিবীর আর কোথাও শান্তি না থাকলেও ভালোবাসার মধ্যে শান্তি আছে। কিন্তু সেটাও আজ ভুল প্রমাণিত হলো। ভালো থেকো।
আমার জীবন যুদ্বে আমি কাউকে পাশে পাইনি। বাবা মা,ভাইবোন, ভালোবাসার মানুষ কাউকে না। দুবেলা দুমুঠো খাবার আর রাতে একটু শান্তিতে বালিশে মাথা রাখার জন্য হলেও একটা চাকরি জোগাড় করেছিলাম। কিন্তু একসময় বুঝলাম এই পৃথিবীতে শুধু শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্যই টাকার দরকার হয় না। ভালো ভাবে মরার জন্যও টাকার দরকার হয়। তখন থেকেই জীবনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলাম। বেশি দূর এগোতে পারিনি। তবে প্রশান্তির একটা জায়গা তৈরি করেছিলাম,ভালো একটা চাকরি জোগাড় করেছিলাম।
আমি যেখানে চাকরি করতাম সেখানে একজন মানুষ ছিলেন যিনি আমাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন তাঁর একটা মেয়ে আছে,নাম আদিবা। একটু জেদি টাইপ,তবে মনটা অনেক সুন্দর। তাকে বিয়ে করতে হবে। আমি প্রথমে রাজী হয়নি। কারণ আমি চাইনি আমার মতো একাকি একজন মানুষ,বিরক্তিকর একজন মানুষের সাথে কেউ জড়িয়ে পড়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করুক। কিন্তু শেষ মেষ বিয়েটা করি। আমি বিয়ে করাতে অফিসের সবাই অনেক খুশি হয়েছিল।
অনেকদিন পর মনে হলো আমার একাকিত্ব জীবনের হয়তো সমাপ্তি হতে চলেছে। অনেক আশা নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকেছিলাম। কিন্তু বাসর ঘরে ঢুকার পর বুঝতে পারি। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সারাজীবন একা থাকার ভাগ্য নিয়ে জন্মায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের একাকিত্ব যায় না। সেই মানুষগুলোর মধ্যে আমিও একজন।
আপনি আপনাকে স্পর্শ করবেন না,আমার অনুমতি ছাড়া।
- কেনো? আপনি তো আমার বিয়ে করা বউ। তাহলে স্পর্শ করতে পারবো না কেনো?
- কারণ আমি আপনাকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নেইনি। বাবার কাছে আপনি নাকি পৃৃথিবীর সবথেকে ভালো ছেলে। আপনার মতো ছেলে নাকি এই দুনিয়ায় আর একটাও নেই। সেজন্য বাবা আমাকে আপনার সাথে বিয়ে দিয়েছেন। বয়ফ্রেন্ডও ছিলো না যে তাঁর সাথে পালিয়ে যাবো। বাধ্য হয়েই বাবার দিকে তাকিয়ে বিয়েটা করেছি। তবে আপনাকে আমার পছন্দ হয় না। আপনি আমাকে ধরলে আমি চিৎকার করবো।
- আমি সবার কাছেই অপছন্দীয়। আপনার কাছে পছন্দনীয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে ভয় নেই,আমি আপনাকে ধরবো না। আপনি এখানে আপনার নিজের ইচ্ছে মতোই থাকবেন। কেউ কিছু বলবে না। আমি বাইরে গিয়ে ঘুমাচ্ছি। অনেক রাত হয়েছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।
আজ আবার খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তবে আজ নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করলাম। যে মেয়েটা আমাকে চায় না তাকে বিয়ে করলাম। কি দরকার ছিল বিয়ে করার? একাই তো ভালো ছিলাম।
যখন এসব ভাবছিলাম তখন প্রায় রাত বারোটা বাজে। আদিবা রুমে ঘুমাচ্ছে। ঠিক সেই সময় আমার প্রাক্তনের ফোন আসে। আমি কখনো কোনোদিন কল্পনা করিনি ইসরাতের সাথে আবার আমার কথা হবে। কিন্তু আমি ফোনটা ধরলাম না।
সে আবার ফোন দিচ্ছে,কিন্তু আমার রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। ফোনটা বন্ধ করে রেখে ঘুমিয়ে গেলাম। যার এতোদিন কোনো খোঁজ ছিলো না। তাঁর সাথে কথা বলার কি দরকার?
তবে কথা বলতে হবে আমি জানি। সকালে ফোন খুলতেই দেখবো আবার ইসরাত ফোন দিবে। তখন হয়তো রিসিভ না করে থাকতে পারবো না। তবে কোন খারাপ খবর শোনার আগে আজকের রাতটা অন্তত একটু ঘুমাতে চাই আমি।
আমি আগে কমেন্ট করেছি, আশা আপনিও করবেন আমার আর্টিকেলে...... আর আপনি যদি subscribe করেন তাহলে আমিও করবো...... আশা করি কথা রাখবেন এবং আমাকেও সাহায্য করবেন