বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি দেশ। এই দেশ একদিকে যেমন সুজলা-সুফলা তেমনিভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও ভরপুর। এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। সুদূর অতীত থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আছেন শত শত প্রকৃতিপ্রেমী। এই প্রকৃতিপ্রেমীরা সময় পেলেই ছুটে আসে স্বপ্নের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশে।
শুরুতেই বলব সুন্দরবনের কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা লবণাক্ত বনাঞ্চল হলো সুন্দরবন। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ সুন্দরবনের ১,৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদী-নালা ও বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বিচিত্র নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত সুন্দরবন। এখানে রয়েছে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ ধরনের উভচর প্রাণী।
সবুজে ঘেরা রেললাইন (ছবি : তৌকির আহমেদ)
সুন্দরী বৃক্ষের নামানুসারে এই বনের নাম সুন্দরবন রাখা হয়। সুন্দরবনের ভেতরে যেতে হলে নৌ-পথই একমাত্র উপায়। শীতকাল সুন্দরবন ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। প্রতিদিনই এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই সুন্দরবনে ঘুরতে আসে অসংখ্য দেশি এবং বিদেশি পর্যটক। সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে তোলে।
এরপর বলব বাংলাদেশের এবং পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের কথা। এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত যা কক্সবাজার শহর থেকে বদরমোকাম পর্যন্ত একটানা ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই মনোরম যে প্রতিদিনের আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দেখেই সেটা বোঝা যায়।
জলের সাথে প্রকৃতির গভীর মিতালী (ছবি : তৌকির আহমেদ)
লাবণী পয়েন্ট: এটিকে কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্র সৈকত বলে বিবেচনা করা হয় যা পর্যটকদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ তৈরি করেছে। প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটকের আগমনে ভরে ওঠে লাবণী পয়েন্ট।
হিমছড়ি: হিমছড়ি কক্সবাজারের ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হলো ভঙ্গুর পাহাড় আর ঝরনা। কক্সবাজার থেকে হিমছড়ি যাওয়ার পথে বামদিকে সবুজঘেরা পাহাড় আর ডানদিকে সমুদ্রের নীল জলরাশি মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি করে। বর্ষার সময়ে হিমছড়ির ঝরনাকে অনেক বেশি জীবন্ত ও প্রাণবন্ত বলে মনে হয়।
ইনানী সমুদ্র সৈকত: দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ছাড়াও কক্সবাজারে সৈকত সংলগ্ন আরও অনেক দর্শনীয় এলাকা রয়েছে যা পর্যটকদের জন্য প্রধান আকর্ষণের বিষয়। ইনানী সমুদ্র সৈকত তার মধ্যে অন্যতম।
এরপরে বলব সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কথা। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ যা মূলভূখণ্ডের সর্ব দক্ষিণে এবং কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ১৭ বর্গ কিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। স্থানীয় ভাষায় সেন্টমার্টিনকে নারিকেল জিঞ্জিরা বলেও ডাকা হয়। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। নীল আকাশের সঙ্গে সমুদ্রের নীল জলের মিতালী, সারি সারি নারিকেল গাছ এ দ্বীপকে করেছে অনন্য।
অনেক তো বললাম সমুদ্র সৈকতের কথা। এবার আসি সিলেটের জাফলং, লালাখাল, রাতারগুলের কথায়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিভাগ হচ্ছে সিলেট। কারণ এই সিলেটেই আছে অনেক দর্শনীয় স্থান। জাফলং, লালাখাল, বিছানাকান্দি, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, কুলাউড়া ইত্যাদি দর্শনীয় স্থান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই সিলেট বিভাগ। তাছাড়া হাকালুকি হাওরের মতো বাংলাদেশের বড় হাওর ও এই সিলেট বিভাগেই অবস্থিত। এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি।
যেখানে দিগন্ত এবং সবুজ প্রকৃতি একি সুতোয় গাঁথা (ছবি : তৌকির আহমেদ)
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কথা ভুলে গেলেও চলবে না। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে এটি অন্যতম। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন পর্যটন কেন্দ্র। এখানে রয়েছে বহু দর্শনীয় স্থান। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে মহাস্থানগড়ে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।
এখানে রয়েছে শাহ সুলতান বলখী মাহিসওয়ারের মাজার শরীফ, জাদুঘর, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর ঢিবি, বৈরাগীর ভিটা, স্কন্ধের ধাপ, মঙ্গলকোট স্তুপ, গোকুল মেধ, কালীদহ সাগর, ভাসু বিহার, শীলাদেবীর ঘাট, জিয়ৎ কুন্ড, গোবিন্দ ভিটা, পরশুরামের প্রাসাদ। এসব স্থান মন কেড়ে নেয় পর্যটকদের। মহাস্থানগড়ের এইসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে যায় সবাই।
এ ছাড়াও বাংলাদেশে রয়েছে পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, বাঘেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, মহামায়া ইকোপার্ক, কুমিল্লার কোটবাড়ি, শালবন বিহার, আনন্দ বিহার প্রভৃতি।
হাজার হাজার বছর ধরে এইসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশ। এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সুদূর অতীতেও রাজা-বাদশা, বিভিন্ন পরিব্রাজক, প্রকৃতিপ্রেমীদের মন কেড়ে নিয়েছিল। আমাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এইসব দর্শনীয় স্থান তথা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
nice