শুধু নারী, নাকি মানুষও??
আমরা কিন্তু একটা বিশ্ব রেকর্ড করেছি। টানা ২৮ বছর ধরে নারী প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনা করছেন (মাঝে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর বাদে)। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এ রকম উদাহরণ নেই। এই রেকর্ডের জোরেই আমাদের দেশে নারীর অবস্থান কিছুটা উন্নত। আগে আমাদের যেকোনো নাগরিকের পরিচয় ছিল বাবার নামে। এখন আইন করে বাবা এবং মা উভয়ের নামের পরিচয়ে আমরা পরিচিত।
দেশে নারী—মা ও বোনের মর্যাদা বেড়েছে সন্দেহ নেই। অথচ তারপরও দেশে নারীরা ঘরে-বাইরে, পথেঘাটে নির্যাতিত হয়ে চলেছেন। চাকরিতে বৈষম্যের শিকার। চাকরির ইন্টারভিউতে নারী প্রার্থীকে চাকরিদাতারা প্রশ্ন করেন, বিয়ে কবে করবেন? তারপর তো সন্তান ধারণ। তখন আবার ছয় মাস ছুটিতে থাকবেন! এই বিষজ্বালা নারীদের প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে। কিন্তু তারপরও নারীরা অদম্য মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। জেন্ডার গ্যাপ বা নারী-পুরুষ বৈষম্যের পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ বেশ এগিয়ে আছে। কিন্তু বিপরীত চিত্রটি খুবই বেদনাদায়ক। পরিবহনে নারীর নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক মাধ্যমে নারীর অবমাননা ও শারীরিক নির্যাতন দেশে নিত্যদিনের ঘটনা।
তাহলে আমাদের দেশে নারীর অবস্থান কোথায়? ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো গত দুই সপ্তাহে দুটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে। একটির আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। অন্যটিতে সেভেন রিংস সিমেন্ট। নেদারল্যান্ডস উন্নয়ন সংস্থার (এসএনভি) সহযোগিতায় আরেকটি গোলটেবিল বৈঠক হবে আগামীকাল ৭ মার্চ। এই তিন আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয় নারীর সমতা, ক্ষমতায়ন, দেশের সমৃদ্ধি সাধনে নারীর ভূমিকা, প্রকৌশল শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, পোশাকশ্রমিকদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও শ্রম আইনের বিধিবিধানের বাস্তবায়ন প্রভৃতি।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রতিটি আলোচনা অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য নারীর ভূমিকা আরও উন্নত করার সুযোগ সৃষ্টি। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী যেন পেছনে পড়ে না থাকে। এটা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রারও (এসডিজি) একটি মূল কথা। আলোচনায় গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ২৮ বছর ধরে আমাদের দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে চলেছেন। এই বিশ্ব রেকর্ডের মর্যাদা আমাদের রাখতেই হবে। কিন্তু এ জন্য নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টভঙ্গি বদলাতে হবে।
একটি উদাহরণ দেখুন। অ্যাকশনএইডের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার ইক্যুইটির ম্যানেজার কাশফিয়া ফিরোজ একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, ঘরের আপনজনই নারীকে কীভাবে ঠকান। গ্রামে ধান বোনা থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ২২ ধরনের কাজের মধ্যে ১৯ ধরনের কাজ করেন নারী। অথচ এরপর তাঁর স্বামী সেই ধান বাজারে নিয়ে বিক্রি করে হাট থেকে একটি রঙিন শাড়ি কিনে এনে বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘ও বউ, তামুক সাজাও, ওহ্, জানটা বেরিয়ে গেল!’
বউয়ের তো খুশি হতেই হবে। কারণ, ভাবটা এমন যে ২২ ধরনের কাজের মধ্যে ১৯ ধরনের কাজ করে তাঁর প্রাপ্য মাত্র ৩০০ টাকার একটি শাড়ি। আর ধান বিক্রির বাকি আড়াই হাজার টাকার মালিক স্বামী। বেচারা কত কষ্টই না করেছেন! নাহলে এই আড়াই হাজার টাকা কি সংসারে আসত? এই বৈষম্যমূলক হিসাব আমরা আর কত দিন মেনে চলব? সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনের ভূমিকাই থাকবে, এটা ঠিক। পরিবারে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ থাকবে, এটাও ঠিক। কিন্তু যখন দেখা যায়, সংসার সামলানোর যাবতীয় অবৈতনিক কাজে একজন নারী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খাটেন ১৪ ঘণ্টা আর পুরুষ খাটেন মাত্র ৬ ঘণ্টা, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, নারী কি শুধু হাড়ভাঙা খাটুনির যন্ত্র?
এই প্রশ্ন প্রায় দুই যুগ আগে জাতিসংঘ তুলেছে। নারীর ঘরসংসারে কাজের আর্থিক পরিমাণ নির্ণয় করে একে জাতীয় আয়ে নারীর অবদান হিসেবে উল্লেখ করার কথা জাতিসংঘ বলেছে। আমাদের দেশে এটা করা দরকার। তখন কিন্তু সব হিসাব উল্টে যাবে। অন্তত কেউই বলতে পারবেন না পুরুষই সব, নারীরা আর কী অবদান রাখেন! কিন্তু প্রকৃত হিসাবে হয়তো দেখা যাবে, নারী-পুরুষ প্রায় সমানতালে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। এতে অন্তত একটি ঘটনা ঘটবে। নারীকে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করার পুরুষালি প্রবণতা কমে যাবে। এটা নারীর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য দরকার।
চাকরির ক্ষেত্রেও নারীদের দাবিয়ে রাখার প্রবণতা সমাজে দেখা যায়। কোনো কোনো পুরুষ সহকর্মী বা বস ভাবেন, নারী কর্মীদের যোগ্যতা থাকলেও বেশি প্রমোশন দেওয়ার দরকার নেই। তাহলে ঘাড়ে চেপে বসবে! এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন পুরুষদেরই করতে হবে। প্রায় দুই দশক আগে একবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে একজন নারী কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, বিভিন্ন অফিসে নারীরা উপযুক্ত মর্যাদা নিয়েই কাজ করছেন। কিন্তু কিছু দূর ওঠার পর আর ওপরে ওঠা যায় না। অদৃশ্য কোনো কাচের ছাদ (গ্লাস সিলিং) আর ওপরে উঠতে দেয় না। আইনকানুনে বাধা নেই বলে কিছু বলাও যায় না।
সেদিন অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু বিষয়টি সত্য। গত বছর বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মোট আটজনের মধ্যে নারী বিজ্ঞানী মাত্র দুজন পুরস্কৃত হয়েছিলেন। এর বাইরে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন একজন নারী। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের মাত্র ৩ শতাংশ নারী। গত এক
দশকে পেয়েছেন মাত্র ৯ শতাংশ নারী। প্রশ্ন উঠেছে, বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যা এত কম কেন? নারী বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কি কম? এ প্রশ্ন এবার তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির অণুজীব বিজ্ঞানী ন্যানসি হপকিন্স। গত বছর তিনি সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ঠিকমতো সুযোগ-সুবিধা ও মূল্যায়ন করা হলে আরও অনেক নারী বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন। নারীদের বিভিন্নভাবে পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়! পেছনে ফেলে রাখা হয়। হপকিন্স তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বলেছেন। বিষয়টি মাসিক বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদকীয়তেও উল্লেখ করা হয় (অক্টোবর ২০১৮ সংখ্যা)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সমস্যাটি বিশ্বব্যাপী। তবে নারীর অধিকার ও সমতা উন্নত দেশগুলোতে অনেক বেশি, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও সেখানে নারীরা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত। আর আমাদের তো যেতে হবে আরও অনেকটা পথ। আমরা প্রচলিত ভাষায় বলি, ‘উনি একজন পুরুষ মানুষ।’ আর অন্যদিকে বলি, ‘উনি একজন নারী!’ কিন্তু নারী কি ‘মানুষ’ না? হয়তো ভাষার সৌন্দর্যের কারণে ‘পুরুষ মানুষ’–এর মতো ‘নারী মানুষ’ বলাটা মানায় না। আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। এর মর্মার্থটি কী? আমরা কি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নারীকে মানুষের মর্যাদায় স্থান দিচ্ছি? সবাই জানি, এ ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে।
কথাটি সেদিন আলোচনায় বলেছিলেন জাতীয় ক্রীড়াবিদ শিরিন সুলতানা। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক স্বর্ণপদক পেয়েছেন। দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তিনি একজন রেসলার। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করি, কেন তিনি ক্রীড়াবিদ হিসেবে রেসলার হলেন? তিনি নির্বিকার উত্তর দেন, যেসব বখাটে ছেলে পথেঘাটে মেয়েদের বিরক্ত করে, তাদের শায়েস্তা করতে! কথাটা তিনি হাসতে হাসতেই বলেন। কিন্তু এখন নারীবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে কাজটা করতে হবে
Yes obviously. .... amra nari amra sob pari