
#লেক_ন্যাট্রনের_জীবন্ত_মমি

লেক ন্যাট্রন প্রকৃতির এক বিস্ময়কর ভাস্কর। ভালোমতো একবার সংস্পর্শে এলেই জীবন্ত পাখিকে এটি ধীরে ধীরে পরিণত করতে পারে যেন পাথুরে স্ট্যাচুতে! হ্রদের রং আবার কোথাও কোথাও রক্ত লাল! আফ্রিকার দেশ তাঞ্জানিয়ায় অবস্থিত সক্রিয় আগ্নেয়পাহাড় লেঙ্গাই, তার ঠিক পাশেই রয়েছে পিলে চমকে দেওয়ার মতো এই হ্রদটি। আশেপাশে একটু ঘুরেফিরে দেখলেই চোখে পড়তে পারে নানান পাখপাখালির মূর্তিসদৃশ ভূতুড়ে সব মৃতদেহ।

লেঙ্গাই পাহাড়ে উঠার পর ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ডেরও চোখ এড়ায়নি খুনে হ্রদটির এই ভৌতিক দৃশ্য। তাই চটপট নেমে এসে পাখি এবং বাদুরের পাথুরে মৃতদেহগুলোকে নানান ভঙ্গিমায় রেখে করে ফেলেন ক্যামেরাবন্দি। সে ছবিগুলোই নিচে দেখছেন।

এবার ফাঁস করা যাক প্রকৃতির এই খুনে কারিগরের গোপন রহস্য। যেমনটা আগে বলা হয়েছে,লেকটির অবস্থান একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির ঠিক পাশেই। প্লাইস্টোসিন যুগে তৈরি লেকটির তলদেশ গঠিত হয়েছে প্রচুর সোডিয়াম ও কার্বোনেট যুক্ত ট্র্যাকাইট লাভা দিয়ে । তাই হ্রদের পানি মারাত্মক ক্ষারীয়, পিএইচ মান ১০.৫-১২। উচ্চমাত্রার ক্ষার মানেই সায়ানোব্যাকটেরিয়ার পোয়া বারো। ওদের লাল রঞ্জকের জন্যই হ্রদের বর্ণ রক্ত লাল থেকে গোলাপি।

আগ্নেয়গিরি সংলগ্ন হ্রদটিতে বছরের অধিকাংশ সময়ে তাপমাত্রা থাকে ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের দিকে, হ্রদে আসা পানি তাই দ্রুতই বাষ্পীভূত হয়ে যায়। তরল হিসেবে যা রয়ে যায় তা হলো নেট্রন (সোডিয়াম কার্বোনেট ডেকাহাইড্রেট) আর ট্রনা (সোডিয়াম সেসকুইকারবোনেট ডাইহাইড্রেট)। অর্থাৎ লবণ এবং সোডার দুর্ধর্ষ এক খুনে যুগলবন্দী।

অনুমান করা হয়, হ্রদের গাঢ় জলে প্রতিফলিত সূর্যের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে আছড়ে পরে হতভাগ্য পাখিগুলো। গায়ে বাজেভাবে জড়িয়ে যায় অত্যন্ত ঘন লবণ এবং সোডা। কেউ সাথে সাথে, কেউবা শুকানোর পর শরীরে জমে থাকা সোডা-লবণের টান ধরা অসহ্য যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। খনিজের আস্তরণে লাশগুলো পরিণত হয় পাথুরে ভারি 'প্রাকৃতিক ভাস্কর্য'এ, প্রকৃতি মায়ের কোলে এক উন্মুক্ত জাদুঘরে।

খুনে হ্রদটির কিন্তু একটি মমতাময়ী রূপও রয়েছে। এটি কি না পূর্ব আফ্রিকার লেসার ফ্লেমিঙ্গোদের বৃহত্তম প্রজননক্ষেত্র! লম্বা লম্বা পায়ের সুবাদে ওরা ন্যাট্রনের গ্রাস থেকে নিজ শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে। অগভীর জলে নীলাভ-সবুজ শৈবালের প্রাচুর্যে অনায়াসে ওদের উদরপূর্তি হয়। যেন লেসার ফ্লেমিঙ্গোদের পরম স্নেহে লালন করার জন্যই খুনে হ্রদ মাতার এতো আয়োজন!
©যুগযান
*মৃতপাখিগুলো 'পাথর' হয়ে যায় না, প্রচুর নুন আর সোডা জমে দেখতে 'পাথুরে' হয়ে যায়। অনেকটা মমির মতো। বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না।

