মুঘল তোপের ইতিবৃত্ত

0 33
Avatar for Montasin11
4 years ago

ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের প্রতিষ্ঠা ১৫২৬ সালে যা ছিল ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা।উপমহাদেশের ইতিহাসে এমন কোন রাজবংশ এতটা প্রলম্বিত হয়নি।

তৈমুরের পঞ্চম অধস্তন জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবুর ভারতবর্ষকে তাঁর সম্রাজ্যিক উত্তরাধিকার মনে করতেন এবং ভারতবিজয়কেই তিনি তার জীবনের প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে মনে করতেন।জীবনের নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি কাংখিত লক্ষ্যে পৌছান।

মুঘল আগমনের ফলে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক,সামাজিক এমনকি সামরিক ইতিহাসের গতিপথ পর্যন্ত আমূল পাল্টে যায়।বাবুরই ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম কামানের ব্যবহার করেন পানিপথের প্রথম যুদ্ধে।এরপর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের সামরিক ইতিহাসে কামানের নাম সবার প্রথম সারিতে থাকবে।

ফারসি অভিধান অনুসারে তোপ শব্দের উৎপত্তি তুর্কি শব্দ থেকে, তবে বাবুর তোপ কে 'জর্ব-জন' শব্দের প্র‍য়োগ করেছেন।১১১৯ হিজরি সনে লেখক কামরাজ ও তার 'আজম উল হরব' গ্রন্থে 'জর্ব-জন' শব্দটির উল্লেখ করেছেন।

ভারতীয় গ্রন্থগুলোতে তোপ শব্দের ব্যবহার ঠিক প্রথম কোথায় কবে প্রচলিত হয়েছিল তা জানা যায় না তবে এ শব্দটি সর্বপ্রথম দক্ষিণাত্যে তুর্কিদের দ্বারা প্রচলিত হয় যারা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে তোপখানার দায়িত্বে ছিলেন।

কিছু লোকের মত হলো,তোপ কেবল অবরোধ করার জন্য বড় আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর জন্যই ব্যবহার করা হতো, কিন্তু আমরা সকল প্রকার তোপের বর্ণনা একই শ্রেনীতে পাই, তা ছোট হোক বা বড়।আকার অনুসারে অবশ্যই তোপগুলোর পৃথক পৃথক নাম ছিল - 'তোপ এ কলা' বা বড় তোপ এবং 'তোপ এ খুর্দ' বা ছোট তোপ।

বাবুর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে মাত্র দুটি তোপের ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে আরো অনেকগুলো তোপ তৈরি করিয়েছিলেন।অবশ্য পানিপথের যুদ্ধে ব্যবহার করা তোপগুলোতে ধংসাত্মক ক্ষমতা অপেক্ষা শব্দ তৈরির ক্ষমতা ছিল বেশি।যার কারণে তোপের অপরিচিত বিপুল শব্দে ইব্রাহীমের হাতিরা ভড়কে যায় ও এদিক ওদিক পালিয়ে যেতে থাকে সাই সাথে নিজেদের লোকেদেরই পিষ্ট করতে থাকে।

বাবুর তাঁর স্মৃতিকথায় তোপখানার মুখ্য অধিকারী উস্তাদ আলী কুলি খাঁ এর নিয়ন্ত্রনে আগ্রায় তোপ সম্পর্কিত কারখানা স্থাপন সম্পর্কে লিখেছিলেন-

"আকার অনুযায়ী তোপের ছাঁচ যন্ত্রের চারিদিকে লোহা গলানোর জন্য আটটি বড় বড় ভাটি প্রস্তুত করা হয়েছিল, ভাটির নিচ অংশে একট নালি বের হয়েছিল,যা ঢালাই এর স্থান পর্যন্ত পৌছাতো। আমার পৌছানোর পরই গলানোর ধাতু বয়ে যাওয়া নালির ছিদ্র খুলে দেওয়া হতো।গলন্ত লোহা ফুটন্ত পানির মতো বয়ে চলল ও দ্রুত ঢালাই স্থানে পৌছে গেল।

কিন্তু সময় পর যখন ঢালাইয়ের ছাঁচ পুরো হতে পারলো না,তখন ভাটির নালিতে গলানো লোহার প্রবাহ ধীমী পড়ে গেল। এর কারণ হলো ছাঁচের আকার অথবা ধাতুর মাত্রার ভুল পরিমাণ।

উস্তাদ আলী কুলি খাঁ এ অবস্থা দেখে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন এবং মনে হচ্ছিল যে,তিনি এই গলানো ধাতুতে ঝাঁপ দেবেন।আমি তাঁকে অনেক বোঝালাম,তাঁকে খিলাত দেবার আদেশ দিলাম এবং এভাবেই তাকে উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্ত ও সন্তুষ্ট করতে সফল হলাম।এর দুদিন পর যখন ছাঁচে গলানো লোহা ঠান্ডা হয়ে গেলো,তখন খোলা হলো, আলি কুলি খাঁ নির্মিত বস্তু দেখে লাফিয়ে উঠলেন এবং আমাকে বলে পাঠলেন যে যন্ত্রের ছিদ্রে(চেম্বারে) কোন দোষ ছিল না সম্ভবত ধাতুর পরিমাপের গন্ডগোল হয়েছিল।

তখন তোপের আকার খুলে দেয়া হলো এবং তার শেষ কাজ সম্পন্ন করার জন্য কারিগর নেয়া হলো।প্রথমে হালকাভাবে তোপের পরীক্ষা করা যেত এবং একটি গোলা প্রায় ১৬০০ হাত পর্যন্ত যেতে পারতো।এরকম ই একটা বড় পরীক্ষনের অবসরে বড় একটি তোপ থেকে গোলা ছোঁড়া হলো,গোলা তো অনেক দূর গেল, তবে তোপ ফেটে গেল, এবং আট ব্যক্তি মারা গেল।

আসলে লোহা ঢালাইয়ে ধাতুর সঠিক মিশ্রন নিয়ে যে গবেষনা হতো না তা এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়।বাবুরের সময়কাল থেকে এর পরবর্তী অনেক কাল পর্যন্ত লোহাকে গলিয়ে ঢালাই করার কলা অধিক বিকশিত করা যায়নি।ডিলাফ্লোট ১৮ শতকে দক্ষিণাত্যের বর্ণনা থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।

তাঁর বর্ণনা অনুসারে,"হিন্দুস্থানি তোপ লোহা ঢালাই এর বিদ্যা দিয়ে প্রস্তুত হতো না, বরং লোহার ছড়গুলোকে একসাথে বেঁধে তৈরি করা হতো এবং জায়গায় জায়গায় লোহার ছড়গুলোকে মুড়ে তা দিয়ে বাঁধা থাকতো।"

ঐতিহাসিক খুশাল চাঁদের মতে,বাবুরের সময়ের তোপগুলোতে তিন ঘন্টাতে একটি গোলা নিক্ষেপ করা যেতো।বাবুরের তোপচি হায়দার আলী খাঁ খুবই কুশলতা ও দক্ষতার সাথে গোলা ছুঁড়তেন ও তা ঠান্ডা হতে দিতেন। তোপে পুনরায় গোলা ভরতেন এবং দুই ঘন্টা পর বান ডাকিয়ে নিতেন।

বাবুরের সময়ে তোপগুলোর গোলার গতি ছিল অনেক কম।কনৌজের যুদ্ধের ব্যাপারে বাবুর লিখেছেন-

"উস্তাদ আলী কুলি খাঁ তোপখানাকে খুবই কুশলতার সাথে সঞ্চালন করেছিলেন। প্রথম দিন তিনি আটটি ও দ্বিতীয় দিন ষোলটি গোলা ফেললেন। এভাবে তিন চারদিন পর্যন্ত লাগাতার গোলা নিক্ষেপ করতে লাগলেন।"

বাবুর কনৌজ যুদ্ধের সময় গাজী নামের একটি বিশাল তোপ ব্যবহার করেছিলেন যেটি আগ্রার তোপখানায় নির্মান করা হয়েছিল।গাজী নামকরণ করা হয়েছিল রানা সাংগার সাথে জয়ের পর৷বাবুর আরো বড় মাপের তোপ তৈরি করিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলো ফেফে যেত ও অনেক সৈন্যের হতাহতের কারন ছিল।

এছাড়া সবসময় তোপ ব্যবহার মংগলজনক ও ছিল না।কারণ ঘোড়সওয়াররা যখন দলে দলএ সামনে এগিয়ে যেত তখন তোপের দ্বারা নিজেকের সৈন্যদের আহত হওয়ার সম্ভবনা বেশি ছিল।তখন তোপের মোহ ত্যাগ করাই বেশি লাভজনক ছিল।

ঐতিহাসিক ব্লেকার লিখেছেন-

যদি তোপ অচল থাকে তবে ঘোড়শওয়াররা শক্তিমান থাকে।তোপের কাজই হলো অগ্নি উদগিরণ করা,যেখানে ঘোড়শওয়াররা যুদ্ধ করে পালিয়ে যাবার সময় পালিয়ে যায় কিন্তু পিছে তোপ রেখে যায় তখন তা একপ্রকার বোঝা হয়ে যায় এবং শত্রুর হাতে পড়ার সম্ভবনা থেকে যায়।"

ফিটস ক্লোরেন্স সন ১৮১৮ ঈসায়ীতে বলেছেন -"এক দেশবাসীর দ্বারা ব্যবহার করা তোপ লোহার বেলুন আকৃতির হতো, যার উপর পিতলের ঢালাই থাকতো।"

"তোপ নির্মানের প্রাথমিক প্র‍য়াসে তারা পরস্পরের সাথে বেঁধে লোহার ছড় তৈরি করে।"

হর্ন মির্জা হায়দারের ভিত্তিতে লিখেছেন,"১৫৪০ সালে কৌনজের যুদ্ধে হুমায়ুনের কাছে ৭০০ তোপ ছিল। প্রতিটি তোপ চার জোড়া বলদ দিয়ে টানা হতো। এই তোপগুলো থেকে নিক্ষিপ্ত গোলার ওজন ছিল চার পাউন্ড।এগুলোর সাথে তার কাছে আরো ২১ টি বড় তোপও ছিল যা টানার জন্য আট জোড়া বলদের প্র‍য়োজন ছিল। এই ভারী তোপগুলো থেকে অন্য গোলার তুলনায় দশ গুন বেশি ওজনের ভারী সীসার গোলা নিক্ষেপ করা যেত যা মূলত দুর্গের দেয়াল ভাঙতে ব্যবহার করা হতো।"

ডাক্তার হর্ণের মতে,মোগল শাসনামলে আকবরের সময়ে তোপখানার সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছিল। তবে 'আইন ই আকবরী' তে বর্ণনা থেকে একথা জানা যায় যে,তোপখানা যদি উন্নতিও হয়ে থাকে তা সাধারণই।এর বিপরীতে বন্দুকের উন্নতি হয়েছিল যথেষ্ঠ বেশি। তবে আজ এটা আবশ্যিক স্বীকৃত যে,আকবর অপেক্ষা আওরংজেবের আমলে তোপখানার উন্নতি যথেষ্ঠ পরিমাণে বেশি হয়েছিল৷

আওরংজেব দক্ষিণে অসংখ্য আক্রমণ চালান এবং বিজাপুর,জিঞ্জি,গোলকুন্ডা আক্রমনের জন্য দক্ষিণে শক্ত তোপখানা আবশ্যক ছিল।তাই তিনি পরবর্তীতে দক্ষিণে ও তোপখানা তৈরি করান৷ এ ছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীতে ও ফরাসি ও ইংরেজ সেনাদের বিবরণ থেকে জানা যায়,মুঘলরা দেশিয় অস্ত্রসস্ত্রের বিকাশ ঘটিয়েছিল এবং তা ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল পরে ইউরোপীর রা মুঘল তোপখানায় প্রচুর পরিমানে নিযুক্ত হতে থাকেন এবং ইউরোপীয় অস্ত্রের গুনগান প্রচার করতে থাকেন।

অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরা মুঘল তোপখানার বিষ্যে খুব বেশি প্রশংসা করেননি।গোলকুন্ডায় নিযুক্ত একজন সেনা আর্থ ১৭৪৬ সালে 'হিস্ট্রি অফ মিলিটারি ট্রানজাকসন ইন হিন্দুস্তান' এ লিখেছেন - "যুদ্ধে ব্যবহার করা তোপসমূহের পুরো ক্ষমতার কথা অনুভব না করে, কখনো তারা ভাবেন না যে একটি তোপ থেকে মিনিটে পাঁচ ছয়টি গোলা নিক্ষেপ করা যেতে পারে, কিন্তু এটা তারা খুব ভালো বোঝে যে,একটি কামান থেকে পনের মিনিটে একটি গোলা নিক্ষেপ করা যায়।

১৮১৫ সালেও হায়দ্রাবাদের নিজাম পনের মিনিটে কামানের একতি গোলা ছুঁড়ে সন্তুষ্ট থাকতেন।

"কেম্ব্রিজ হিস্ট্রি অফ ওয়ার" নিম্নলিখিত মত প্রকাশ করেছেন- "তোপখানা সম্বন্ধে সিপাইরা বিশেষ করে তাদের সর্দারদের মিথ্যা আত্মতুষ্টির চেয়ে বেশি ভয়ানক হল একচেটিয়াভাবে তাদের তোপের উপর নির্ভরশীলতা।তারা মূর্খের মতো তোপখানার ক্ষমতার উপর বেশি বিশ্বাস রাখে এবং এটাই তাদের ঘাতক ভুল যে,তারা বৃহৎ হতে বৃহত্তর তোপের উপর ভরসা রাখে,যেখানে তারা এগুলোর উপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন রাখতে পারে না। "

"তারা নিজেদের তোপগুলোর খুব ভালো ভালো নাম রাখতে পারে, এবং তারা এগুলো নিয়ে খুব গর্বিত,যেগুলো থেকে ৭০ পাউন্ড পর্যন্ত গোলা অচিরেই ছোঁড়া যায়,যখন আমরা হালকা লড়াকু তোপ দিয়ে তাদের গহইরে ফেলি তখন তাদের বড় কামানগুলো সরিয়ে ফেলতে হয়। "

১৭৯১ সালে মারাঠাদের দ্বারা তোপখানা সঞ্চালনের সাথে সম্পর্কিত নিম্ন লিখিত বর্ণনা মোগল তোপখানার উপরেও লাগু করা যেতে পারে - একবার তোপে গোলা ভরে নেয়ার পর তোপচিরা আধা ঘন্টা অবধি গল্প ওড়াতেন এবং ধূমপান করতেন। তোপে পুনরায় গোলা ভরা হতো এবং লোকেরা আবার গল্প জুটাতো। এভাবে সকাল থেকে দুপুর অবধি চার পাঁচটি গোলা ছোঁড়া যেত।

রাত্রি বেলায় তোপ চালানোর গতি কমে আসত কিন্তু বন্দুক চলতো ধুন্ধুমার।

কর্নেল হেক্টর মুনরো (১৭৬৩-১৭৭২) এর মধ্যবর্তীকালীন সময়ে লিখেছেন,"এই সময়ে ভারতীয় নবাবেরা ইউরোপের যন্ত্রপাতি দ্বারা নিজেদের অস্ত্রাগার সজ্জিত করতে পছন্দ করতেন।

মুঘল সম্রাটদের তোপখানা বিভিন্ন উপবিভাগে বিভক্ত ছিল -

১/নির্মাণ কর্তা বিভাগ। ২/সংরক্ষন বিভাগ।

এই দুটি বিভাগ মীর আতশের অধীনে থাকতো যাকে তদারকি করতেন শাহি খানসামা।

৩/বাস্তবিক প্র‍য়োগে ব্যবহার্য যুদ্ধ তোপ। ৪/কেল্লা রক্ষার জন্য ব্যবহার্য তোপ।

এটা মীর আতশের প্রতক্ষ অধীনে থাকতো।

মুঘল সম্রাটদের ভারী তোপ রাখার খুব সখ ছিল,যদিও এমন তোপ গুরুত্ব প্রদর্শনের জন্য বেশি থাকতো।ফিটজ ক্লেরেন্সের মতানুসারে,মোগলরা নিজেদের তোপের ওজন ও বড় আকার থেকেই এবং নিজেদের তোপখানাকে পর্তুগিজদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী বলে সিদ্ধ করতে চাইতেন। এসকল বড় তোপ যত গর্জাত,তত বর্ষাত না।সেই সাথে এগুলো ফেটে যাবার ভয় থাকত,এগুলোর সাথে সিপাহীদের মৃত্যুর ঝুঁকি ব্যাপক ছিল৷

মুঘল তোপগুলোর নাম তাদের হাতিদের মতোই ভীতিকর ও গাম্ভীর্যপূর্ণ ছিল। যেমনঃ খাসীয়ান (সর্বজয়ী),শের দাহন (সিংহমুখ), জাহানকোষা (বিশ্বজয়ী)। আওরংজেবের শাসনকালে তাঁর ব্যক্তিগত অভিযানের জন্য ৭০ টি তোপ ছিল,যার অধিকাংশই ছিল পিতলের তৈরি।বাদশাহ যখন শিকারে যেতেন কিংবা নদী পার হবার প্র‍য়োজন পড়তো, এগুলো বাদশাহর সাথে চলতো না৷ভারী তোপগুলো নিয়ে পুল পার হওয়া যেত না। এই ৭০ টি তোপের ভেতর অনেকগুলো এত ভারী ছিল যে, ২০ জোড়া বলদ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত।পাহাড়ী রাস্তায় বলদ যখন টানতে পারতো না, তখন হাতির পিঠে চড়িয়ে বা হাতি দ্বারা ধাক্কা দিয়ে টেনে নেয়া হতো৷

এই ভারী তোপগুলো নিয়ে দ্রুত চলাচল ও করা যেত না আবার নিয়ে চললেও গতি মন্থর হয়ে যেত।তাই এদের জায়গায় জায়গায় রেখে যাওয়া ভালো ছিল।১৭০৭ সালে আজম শাহ যখন ধৌলপুরের দিকে অগ্রসর হন তখন গতি বৃদ্ধি করতে জায়গায় জায়গায় তোপ রেখে যান এবং যখন জাজাউর যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছান তখন তার কাছে একটি তোপ ও ছিল না।

১৭১২ সালে বাহাদুর শাহের পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার যুদ্ধে লাহোরে অধিক ওজনের ৩ টি তোপ সরিয়ে নেয়া হয়েছিল যা ২৫০ বলদের সাহায্যে টানা হতো যদিও লাহোর সম্মুখবর্তী শিবির তিন চার মাইলের বেশি দূর ছিল না তথাপি এটি পৌছতে দশ দিন লেগে যায়।

১৭১৫-১৬ সালে রাজা জয়সিংহ মূল কেল্লায় চূড়ামণি জাঠকে অবরোধ করেছিলেন, তখন এই প্রকারে একটি তোপ দিল্লি থেকে তার কাছে পাঠানো হয় এবং তা দেখাশোনার জন্য আগ্রার সুবেদারকে পাঠানো হয়।এ দ্বারা নিক্ষিপ্ত প্রত্যেকটি গোলার ওজন ছিল এক মণ।১৭১৯ এর আগ্রা অবরোধ কালে শের দাহন,ধূমধাম,গাজিখান ব্যবহার করা হয় যেগুলো প্রত্যেকটির একমণ থেকে দেড়মণি গোলা ছোঁড়ার সক্ষমতা ছিল। সম্রাট মুহম্মদ শাহ এর আমলের তোপগুলোতে ৫০০-৭০০ টি পর্যন্ত বলদের প্র‍য়োজন ছিল আর তাদেত সাহায্যের জন্য থাকত গড়ে পাঁচটি করে হাতি।

রাজা সুরজমল মারাঠাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় তোপটি ছিনিয়ে এনেছিলেন যার জন্য ১১০০ বলদ লাগতো।কিন্তু এটা নিয়ে সে আগ্রায় আসতে পারেনি কারণ পথেই বর্ষা এসে যায় এবং তোপটি ওখানেই আটকে যায়।

আঠারো শতকে এসে তোপ বিস্ফোরণে মৃত্যুর হার মনে যায়। ভারতবর্ষের তোপগুলো মূলত গাড়িতে চড়িয়ে নেয়া হতো তবে দূর্গ রক্ষায় ব্যবহার করা তোপগুলো স্থানান্তরিত হতো না। এগুলো প্রাচীরের উপর রাখা হতো এবং গোলা হিসেবে গোল করে কাটা পাথর ব্যবহার করা হতো যেগুলো অনেকদূর পর্যন্ত গড়িয়ে গড়িয়ে যেত এবং এগুলোর সামনে ঘোড়া বা হাতি দাঁড়াতে পারতো না।

ডাক্তার হর্ণ শাহজাহানের তোপের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।যেমনঃ জাহানকোষা নামের একটি কামানের দৈর্ঘ্য ছিল ১৭ ফুট, নলের ছেদের গভীরতা -১৫ ফুট,তোপের মুখের ব্যাস-১ফুট।

দারাশুকোর কান্দাহার অভিযান উপলক্ষ্যে লাহোর থেকে শাহজাহান দুটি তোপ ঢালাই করান যা ৪৫ কেজির গোলা ছুঁড়তে পারতো।এই তোপ দুটির নাম ছিলঃ ফতেহ মুবারক, কিশওয়ার কুশা৷দারার ব্যক্তিগত দুটি তোপ ছিল-'কি-লা কুশা' ও 'মরিয়ম'।

আওরংজেব তাঁর ব্যক্তিগত তোপ আহমেদনগরেই রেখেছিলেন।যার দৈর্ঘ্য ছিল ২৫ ফুট,এটি ৮০ ভাগ তামা ও বিশ ভাগ টিনের তৈরি ছিল।

এই তোপের বিভিন্ন অংগের মাপঃ

১/নলের পেছনের ব্যাস -৪ ফুট ১০ ইঞ্চি।

২/নলের সামনের ব্যাস-৫ ফুট ৫ ইঞ্চি।

মালিক ই ময়দান নামক তোপ আওরংজেবের দক্ষিণের সুবেদার থাকাকালীন তৈরি করিয়েছিলেন। এর নির্মাতা ছিলেন মুহম্মদ নামক তুর্কি।

ফিটজ ক্লেরেন্স একটি তোপের বর্ণনা দিয়েছেন 'দি গ্রেট গান অফ আগ্রা' বলে যার গোলা নিক্ষেপের ছিদ্রের দৈর্ঘ্য ছিল ১৪ ফুট এবং তার ভেতরনাকি অনেয়াসে একটি মানুষ বসে থাকতে পারতো। তোপটির মূল্য ছিল সেই সময়ের স্বর্ণমুদ্রায় ৫৩,৫০০ টাকা ও টাকার হিসেবে ১,৬০,০০০ টাকার উপরে।

১৮১৮ সালে তোপটি আগ্রা দুর্গের বাইরে যমুনার তটে পড়ে ছিল। পরে সেটাকে কোলকাতায় নেয়ার চেষ্টা করা হয়।জেনারেল লেক এর ইচ্ছা ছিল এটিকে প্রথমে কোলকাতায় ও পরে লন্ডনে নিয়ে যাবার কথা ছিল।পরে এটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি মজবুত নৌবহর বানানো হয়,কিন্তু এই তোপ এত ভারী ছিল যে তা নৌবহর সমেত ডুবে যায়। আর এটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।

লর্ড লেক ১৮০০ সালে আগ্রায় ৪০০ কেজি ওজনের গোলা নিক্ষেপকারী আরেকটি তোপ দেখেন যা দেখতে আগ্রার বড় তোপটির মতোই ছিল।এর সাথে আরো ৭৬ টি পিতলের তোপ,৮৬ টি লোহার তোপ ছিল, যেগুলোতে মর্টার, হাউয়িৎজার,ক্যারোনে,গেইল ইত্যাদি প্রকারের কামান ও ছিল। পিতলের তৈরী তোপ আগ্রা ও দিল্লিতে সমানই ছিল।

মুঘলদের তৈরিকৃত অন্যান্য বিশাল তোপগুলো লাহোরে রাখা ছিল৷এর মধ্যে একটি হল 'জমজম'।বলা হয়ে থাকে এটি আহমদ শাহ আবদালি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন। তবে এই তোপটির গায়ে লেখা ১৭৬৫-৬৬ সাল। এখন এটিই ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা বা এই নামে অন্য কোন কামান ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দিহান।

আরো একটি বড় তোপ যেটিকে যমযম এর যমজ বোন বলা হতো সেটি চেনাব নদীতে তলিয়ে যায়।এর গায়ে উৎকীর্ণ ছিল একটি পংক্তিঃ

'বাদ তসলীম বা গুফতা

তোপ পায়কার এ অজদহে আতশবাজ।'

'অগ্নি উৎকীরনকারী সর্পের মতো আগুন উগরে দেয়া তোপ'

অহশাম এর কর্মচারীদের সূচিতে একটি পদ মেলে 'দেগ অন্দাজ' বা বর্তন নিক্ষেপকারী।ওই সময়ের প্র‍য়োগ অনুসারে দেগ এর ব্যবহার তোপ এর জন্য হয়ে থাকবে, সপ্তদশ শতকে এ নাম দ্বারা ওই অর্থই রাখতো।

সংগরাদ নামের তোপগুলি পাথর নিক্ষেপকারী তোপ ছিল।

সরকোব নামের তোপগুলো সবচেয়ে ভারী প্রজাতির তোপ ছিল। এগুলো দুর্গের দেয়াল ভাঙার কাজে ব্যবহার করা হলো।জওহর আফতাবচী এই চুনার দুর্গ দখলের সময় এই সরকোব তোপের প্রথম উল্লেখ করেন। নিজামউদ্দীন তবকাত এ আকবরী তে এ তোপগুলোকে বলেন 'মুকাজিল কোব'।

কাফী খান আওরংজেবের শাসনামনে ১৬৬৮-৬৯ এ লিখেছেন 'ও তোপ এ হওয়াই ব হম রসাদ বরদরখত হ এ বস্ত, ওয়াক্ত এ শব তরফ এ দন্দা রাজপুরী আতশ মীদাদ।'

'কিছু হাওয়াই তোপ লাভ করা হলো এবং সেগুলোকে গাছের উপর স্থাপন করে দন্দা রাজপুরীর দিকে দাগা হলো।'

মআসির আলমগীরী তে চাদর নামের এক প্রকার তোপের উল্লেখ রয়েছে যেখানে ১৬৮৬ সালে মুঘল সেনার গোলকুন্ডা অবরোধের সময় ব্যবহার করা হয়েছে। 'ও য়ক তসসূজ পেশ কদম ন শুদন-এ- মরদুম আজ বারিশ এ তুফগং ও বান চয় চাদর ও হুক্কা গৈর অজ কুশত শুদন ও জখমী গরদীদন মকসদ সূরতন গিরফত'

-'চাদর ও হুক্কার বর্ষনের ফলে লোক এক ইঞ্চি আগে বাড়তে পারলো না ও আহত বা মৃত্যুবরণ ছাড়া তাদের কাছে আর কোন রাস্তা ছিল না।'

হুক্কা শব্দটি কালিঞ্জর অবরোধের সাথে সম্পর্কিত।শের শাহ প্রাচীরের কাছে দা্ঁড়িয়ে ছিলেন দুর্ভাগ্যবশত একটি হুক্কা প্রাচীরের সাথে ধাক্কা লেগে ফিরে আসে এবং অন্য হুক্কাগুলোর উপর গিয়ে পড়ে ফলে বিস্ফোরণ হয়ে আগুন আগুন লেগে যায় এবং শের শাহ টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যান।

স্টেনগানের মতানুসারে হুক্কা এ আতশ হল এক প্রকার রকেট। ১৬৩৪-৩৫ সালে বুন্দেলখন্ড অবরোধের সময় ও এই হুক্কার প্র‍য়োগ হয়েছিল।

Sponsors of Montasin11
empty
empty
empty

2
$ 0.00
Sponsors of Montasin11
empty
empty
empty
Avatar for Montasin11
4 years ago

Comments