সম্প্রতি বাংলাদেশের দুটি পেজে লেখা দেখলাম শেখ মুজিব হত্যা ও বাংলাদেশে আর এন কাও এর (ছদ্মবেশে) আগমন নিয়ে।এছাড়াও একটি ইতিহাসের গ্রপেও এই ব্যাপারে লেখা দেখলাম এবং এই নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে। সেই উদ্দেশ্যেই এই পোস্টটি দিলাম।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত ১৯৮৭ সালে এক সম্পাদকীয় তে লেখেন, "ওই অভ্যুত্থান সম্পর্কে ভারত সরকারের কাছে আগাম তথ্য থাকার পরও তারা মুজিবকে বাঁচাতে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।তবে আমি (সুখরঞ্জন) ১৯৭৭ সালের ৩০ নভেম্বর ইন্দিরাকে প্রশ্ন করেছিলাম।তিনি বলেছিলেন, " আমরা জানতাম কিছু একটা ঘটতে চলেছে"।
১৯৭৫ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধান দায়িত্বে ছিলেন রমেশ্বর নাথ কাও।
তবে ১৯৭৭ সালে কুলদীপ নায়ার খোলাখুলিভাবেই লিখেছেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র' বাংলাদেশের অভ্যুত্থান সম্পর্কে অস্পষ্টতম কোন সূত্র থেকে অবহিত ছিল না। এরপর থেকেই সঞ্জয় গান্ধী র' কে "রিলেটিভ অফ ওয়াইভস অ্যাসোসিয়েশন" বলে ডাকতে শুরু করেন।
১৯৮৮ সালে ইংরেজি সাময়িকী সানডে এক নিবন্ধে উল্লেখ করে " র' ১৯৭৫ সালে ব্যর্থ হয়েছিল এবং তা প্রতিহত করতে তা মুখে বলা ছাড়া তারা আর কিছুই করেনি"
এই নিবন্ধের আরো দাবি "মুজিব হত্যাকান্ডে হতাশ হয়ে কাও ও শংকরণ নায়ার জিয়াউর রহমানকে হত্যা করতে চক্তান্ত করেন"।
পরে ১৯৮৯ সালে ইংরেজি সাপ্তাহিক সানডের এপ্রিল ২৩-২৯ সংখ্যায় কাও এই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে লেখেন,
"পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের আগে সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করা হয়েছিল।"
"বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল অসন্তুষ্ট সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে, এই তথ্য আমরা ১৯৭৩ এর শেষের দিকে পেয়েছিলাম। আমি এ নিয়ে সে সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলি। তাঁকে জানাই যে এ তথ্য আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র থেকে পেয়েছি এবং এই সূত্রের নাম যেকোনো মূল্যে গোপন রাখতে হবে।"
(কাও এর উল্লিখিত সূত্রের নাম কখনোই আর জানা যায়নি তবে তিনি যে শেখ মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন সহচর ছিলেন এবং তিনি সবসময়ে শেখ মুজিবের আশেপাশে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যেই থাকা একজন ছিলেন তা পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে)
-মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকান্ড।
প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে আমি ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা সফরে যাই। এই সফরকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় আমি তাঁকে পায়চারি করতে করতে বঙ্গভবনের বাগানে যেতে অনুরোধ করি। সবার অগোচরে নিয়ে গিয়ে আমি আমার তথ্য তাঁকে জানাই যে তাঁর জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে। তিনি সে সময় আনন্দপূর্ণ একটি পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন। তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, “ওরা সবাই আমার নিজের ছেলে। আমাকে আঘাত করবে না।” আমি কোনো ধরনের তর্কের মধ্যে না গিয়ে কেবল বললাম, আমাদের তথ্য নির্ভরযোগ্য এবং এই ষড়যন্ত্রের যেসব তথ্য পেয়েছি, তা বিস্তারিত পাঠাতে পারব।’
আর এন কাও এরপর লেখেন, ‘এই আলোচনার অংশ হিসেবেই ১৯৭৫ সালের মার্চে আমি র' এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ঢাকায় পাঠাই কিছু প্রমাণ সহ সেই সাথে আন্তর্জাতিক তৎপরতার ও কিছু প্রমাণ পাঠাই। তিনি ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে যেসব তথ্য আমাদের কাছে আছে, সে অনুযায়ী তাঁকে জানান যে সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট, বিশেষ করে গোলন্দাজ (আর্টিলারি) ও অশ্বারোহী বাহিনী (ক্যাভালরি) তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু দুঃখজনক যে শেখ মুজিব আমাদের সব সতর্কতাই উপেক্ষা করেছিলেন।’
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এই বার্তা তিনি নানাভাবেই পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই বিশ্বাস করতে পারেননি কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে।
ইন্দিরা গান্ধীর বান্ধবী ও তাঁর বায়োগ্রাফির লেখিকা পুপুল জয়কার ১৯৯২ সালে লিখেছেনঃ
"মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার ব্যাপারে ১৯৭৩ এর শেষের দিকেই নিশ্চিত ছিলেন কাও।তাঁর হাতে আসা প্রতিবেদনে এটা নিশ্চিত ছিল যে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বিদ্রোহ ঘনিয়ে আসছে"
১৯৭৩ সালের দিকে র বাংলাদেশে বড় ধরনের বিশৃংখলার ইংগিত পেতে শুরু করে৷এছাড়াও অন্যান্য সূত্রমারফত বিদেশি গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর অতিরিক্ত সচলতার ইংগিত পাওয়া যায়।শংকর নায়ার বাঘা সিদ্দিকীকে নিয়ে শেখ মুজিবের সাথে ১৯৭৩ সালেই দেখা করেন এবং বাংলাদেশে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এত চাঞ্চল্যকর তৎপরতা নিয়ে কথা বলেন।কিন্তু মুজিবের কাছে সেসময় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো ব্যাপারগুলো নিয়ে দম ফেলার ফুসরত ছিল না তাই এই নিয়ে আর কিছু ভাবেননি।
চারমাস পর জিয়াউর রহমানের বাসায় কর্মরত একজন র' এজেন্ট মেজর ফারুক,মেজর রশিদ ও ওসমানীর একটি তথ্য লাভে সমর্থ হয়।তিন ঘন্টাব্যাপী এ আলোচনায় একজন অংশগ্রহনকারী উদ্দেশ্যহীনভাবে কাগজে কিছু লিখে ফেলেন এবং তা অমনোযোগবশত ওয়েস্ট বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দেন। সেই কাগজটি কেরানীর ছদ্মবেশে থাকা সেই র এজেন্ট উদ্ধার করেন এবং দিল্লিতে র এর সদরদপ্তরে পাঠিয়ে দেন।
অভ্যুত্থান অত্যাসন্ন বুঝতে পেরে এবং এর সংগে কারা জড়িত হয়ে তাদের ব্যাপারেও সম্পূর্নভাবে নিশ্চিত হয়ে কাও জুলাই মাসে একজন বিশ্বব্যাপী রপ্তানীকারকের ছদ্মবেশে ঢাকায় আসেন।শেখ মুজিবকে পূর্বনির্ধারিত একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। মুজিব একে চরম নাটকীয়তা রুপে গন্য করেন এবং কাও চাইলে তার সাথে সরকারীভাবে কেন দেখা করলেন না তা ভেবে অবাক হন।মুজিব কাও আলোচনা ঘন্টাব্যাপী স্থায়ী হয়। কাও মুজিবকে সন্তুষ্ট করতে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হন তথাপি তিনি এ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত সকল ব্যক্তির নাম উল্লেখ করার পর শেখ মুজিব বলেন,
"আরে ওরা তো আমার সন্তান। ওরা আমাকে কখনো হত্যা করবে না"
কাও ফিরে আসেন এবং সেই সাথে মুজিবের মৃত্যুঘন্টাও বেজে উঠে।
মুজিবকে র এর সতর্ক করার বিষয়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন মার্কিন মিশনারি ডাক্তার ড.ভিগো অলসেন।১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে তিনি "মালুমঘাট চকরিয়া মেমোরিয়াল ক্রিশ্চান হসপিটাল প্রতিষ্ঠা করেন"। যদিও এই ডাক্তার ভিগো ছিলেন সি আই এ এজেন্ট এবং মিশনারি হাসপাতাল বলা হলেও আসলে এই হাসপাতালটি হয়েছিল সি আই এর অর্থায়নে।
যাই হোক, ১৯৯০ সালে ডাক্তার টু নামে তার লেখা বই বের হয়।সেখানে তিনি নিজেকে " ডিপ্লোম্যাট অফ আমেরিকান বোর্ড অফ সার্জারি" বলে উল্লেখ করেছেন।
এই বইয়ের ২৪৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন,
"ভারতের র' বাংলাদেশের ঘটনাবলীর নিবিড় পররযবেক্ষন করছিল। এটা তাদের পক্ষেই সম্ভব কারণ
সমগ্র দেশের নীচ থেকে শীর্ষ সমস্ত জায়গাতেই তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। তবে অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠছে।র' তাদের পাওয়া তথ্যসমেত শেখ মুজিবকে অবহিত করেছিল। সম্ভবত ফারুক বা রশিদের একজন জিয়ার বাড়িতে বৈঠকের সময় কাগজে কিছু একটা লিখেছিলেন এবং নিশ্চিতভাবে তা পেপার বাস্কেট এ ফেলে দায়।এর কিছুদিন পর কাও মুজিবের সাথে ব্যবসায়ী সেজে দেখা করতে আসে এবং ঘন্টা খানেক অবস্থান করেন। মুজিব সহাস্যে সবকিছু উড়িয়ে দেন৷যদিও র' তাঁকে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে কয়েকজনের নামও উল্লেখ করেছেন। "
এখানে বলতে হচ্ছে, মার্কিন প্রশাসন ও মুজিবকে কোনভাবে সতর্ক করেছিল। মুজিব হত্যার খবর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পৌছানোর পর সেখানকার বাংলাদেশ ডেস্কের সবাই প্রায় বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়।যদিও মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টার প্রতিক্রিয়াহীন ছিল।কারণ তিনিও ৭৫ সালের মার্চের মধ্যেই শেখ মুজিবকে সতর্ক করে এসেছিলেন।
১৬ আগস্ট মার্কিন সময় সকাল আটটা। হেনরি কিসিঞ্জারসহ সকল মার্কিন উর্ধতন কর্মকতা বৈঠকে বসেছেন।শুরুতেই আলফ্রেড আথারটন বলে উঠলেন, অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সংগঠিত একটি অভ্যুত্থান।
কিসিঞ্জার প্রশ্ন করলেন "তাঁকে (মুজিবকে) কি আমরা এ ব্যাপারে কিছু বলিনি?"।
"আথারটনঃ মার্চেই তো আমরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম।
কিসিঞ্জারঃ আমরা কি জানাইনি?
আথারটনঃ হাঁ
কিসিঞ্জারঃ কারা করতে পারে আমরা বলিনি?
আথারটনঃ আমরা নামধামের আভাস দিয়েছিলাম তবে নিশ্চিত করে বলিনি।
হিল্যান্ডঃ আমরা নামগুলোর ব্যপারে অনিশ্চিত ছিলাম।
আথারটনঃ আমার সাথে কথা বলার সময় তিনি তুড়ি মেরে উরিয়ে দেন।
কিসিঞ্জারঃ ওরা (ভারত) কতদূর করেছিল?
আথারটনঃ কাও এসেছিল দেখা করতে৷পরে বোধহয় আবার এসেছিল।আর ওদের লোক তো আছেই। নামগুলোর ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না তবে ওরা বোধহয় নিশ্চিত।
কিসিঞ্জারঃ (মুচকি হাসি দিয়ে) বিশ্বসেরা বোকাদের অন্যতম ছিলেন তিনি।"
এরপর কিসিঞ্জার আবার নামগুলো জানতে চাইলেন।
আথারটন বললেন,সাধারণভাবেই ওরা কম ভারতপন্থী বরং মার্কিনপন্থী ও সোভিয়েতবিরোধী। কিসিঞ্জার আবার বললেন (এবারও মুচকি হাসি দিয়ে), "অবশ্যই এটা অনিবার্য।" একটু পর কেশে বললেন,"না,ঠিক মার্কিনপন্থী হবেন,তা আমি বলতে চাইনি।
-মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকান্ড
(এখানে এই কথোপকথনটি দেওয়ার কারণ হচ্ছে এখানে উল্লিখিত কাও এর করা সতর্কতার কথা।মুজিব হত্যাকান্ডে মার্কিনীদের কথা বলতে গেলে কয়েক পর্বের ধারাবাহিক লিখতে হবে।)
১৯৭৪ সালে এক গোপন তারবার্তা থেকে জানা যায়,হেনরি কিসিঞ্জারের " আমরা কি তাঁকে জানাইনি" এ কথার গূঢ় অর্থ ছিল মুজিব হত্যাকান্ডের কুশীলব ফারুক ৭৪ এর অক্টোবরে কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের আগেই এ ব্যাপারে একটি সুপরিকল্পিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন।
স্টিফেন আইজেনব্রাউন মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শেখ হাসিনার তীব্র অসন্তোষ রয়েছে।কারণ, তাঁর বাবার হত্যাকান্ডে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোন অ্যাকশন নেয়নি।আসলে ভারতই শেখ মুজিবকে বাঁচাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল।
পরিশেষে বলতে চাই, আর এন কাও এর ছদ্মবেশে আগমন নিয়ে অনেকেই সন্দেহ করছেন ভুল কিন্তু তা বলা যায় না। সেই সাথে তারা বলে থাকেন যে কাও চাইলেই তো যখন তখন সে সময় বাংলাদেশে আসতে পারেন সবার চোখ এড়িয়েই। ছদ্মবেশ এর ব্যাপারটা আসলে লেখকের নাটকীয় লেখা ছাড়া আর কিছু না।
কিন্তু কথা হচ্ছে কাও এর ছদ্মবেশে আসাটা আমি অবশ্যই মেনে নেব কারণ সে সময়ের বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকারীদের সর্বত্র দৃষ্টি,আন্তর্জাতিক দেশসমূহের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং সকলের চোখে পড়ে যাওয়া সব মিলিয়ে কাওকে ছদ্মবেশে আসাটাই সবথেকে যুক্তিপূর্ন ছিল।