শরদ এলেই আমাদের বাড়ির বাইরেটা সকাল বেলায় শিউলি ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকতো। কখনো কোচড় ভরে এনে মালা গাঁথতাম। মা বকতেন ঘরে ময়লা হবে বলে। বাবা বলতেন, থাক না।
হিম হিম হাওয়ায় লালপাড় সাদা গরদের শাড়ী পড়া হিন্দু অঙ্গনারা কাঁসার থালা ভরে সেই ফুল তুলতেন শারদীয় পূজার অর্ঘ্য দেবেন বলে। সকাল বেলায়ই পবিত্র হয়ে উঠতো মনটা। স্কুল থাকতো ছুটি। বাবার কাছে সকালের পড়া সেরে দে ছুট দূর্গা বাড়ীতে।
দেবীর খড়ে গড়া মূর্তি বানানো থেকে শুরু করে চক্ষুদান, বোধন -মহালয়া- বিসর্জন পর্যন্ত সকল আচার অনুষ্ঠানের একান্ত দর্শক ছিলাম আমরা ছোটোরা। পুরোহিতের বেদমন্ত্র পাঠের সাথে সাথে ঢাকের বাজনা, আর মাইকে বাজতো হারানো দিনের গান---"চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে, জীবনে তোমায় যদি পেলাম না। "হিন্দু আবাল-বৃ্দ্ধ-বনিতারা নতুন পোশাকে এসে দেবীকে প্রণাম করতেন। কখনো মেয়েরা পূজায় সহযোগীতা করতেন পুরোহিতকে। এমনি এক সকাল বেলায় ইতুদি' গরদের শাড়ী পরে পূজা -আর্চার এটা সেটা করছিলেন। আমার এখনো মনে হয় এমন পবিত্র সুন্দর মুখ আমি আর দেখিনি।
রাতে হতো আরতী। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমরা আরতি দেখতে যেতাম। কতো যে সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যেতো সে অনুষ্ঠানে। এমনি করে চলে আসতো বিসর্জনের পালা। দেবীর সারা মুখ ভক্তদের দেয়া সিঁদুরে ছেয়ে যেতো। খুব অবাক হয়ে দেখতাম হিন্দু বর্ষীয়সী মহিলাগন খুব কান্নাকাটি করছেন। তাদের কান্না ছোটোবেলায় মনে কৌ্তুকের উদ্রেক করলেও এখন বুঝি হয়তো পরের বছর আবার দেখবেন কিনা এই উৎসব কিংবা তাদের মেয়ে হয়তো পূজার শেষে চলে যাবেন শ্বশুরালয়ে-----এইসব ভেবে হয়তো তারা অশ্রু বিসর্জন করতেন।
দূর্গা বাড়ীর পূজাকে জামালপুরের প্রধান পূজা বলে গন্য করা হতো। তাই বিসর্জনের সময় সারা শহরের সমস্ত প্রতিমা নিয়ে ভক্তরা আসতেন দূর্গা বাড়ীর সম্মুখে। সেখান থেকে শুরু হতো বিসর্জনের পাগলপারা নৃ্ত্য। আমরা ছোটোরা রাস্তার পাশের অল্প উচু পাচিলে বসে দেখতাম সেই মহোৎসব। আর আশা করতাম আমাদের বাড়ীর কাছের দূর্গা বাড়ীর প্রতিমা আর সকল ্প্রতিমার চেয়ে সুন্দর হবে। আমাদেরটা ফার্ষ্ট।
কিন্তু কোনোদিন বিসর্জন পর্যন্ত নদীর ঘাটে যাইনি। তাই মনে হতো, না জানি কি এলাহী কান্ড ঘটে সেখানে। এমনি করে হিন্দু-মুসলমান মিলে সম্প্রীতির মধ্যে বেড়ে উঠেছিলাম আমরা। সবাই সবার আত্মীয় হিসাবে মফস্ব্ল শহরের ছোট্ট ছায়াঘেরা পরিমন্ডলে।